
ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে গত ১৫ বছরে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিসহ সহযোগী প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা যে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তার বেশির ভাগই তারা সুইজারল্যান্ড, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ইউরোপের বিভিন্ন বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ৮৩ জনের বেশি মন্ত্রী-এমপি, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তা এই পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে। অর্থ পাচারকারীদের তালিকা আরো দীর্ঘ হতে পারে বলে জানিয়েছে দুদক।
অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, দুদকের আমলে নেয়া অভিযোগ এবং কমিশনের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে প্রায় সব মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউতে তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে সম্পদের তথ্য চেয়েও এমএলএআর করা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর গত এক মাসে অভিযোগ আমলে নেয়া ব্যক্তিদের ৮৩ জনই মন্ত্রী-এমপি। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক মন্ত্রী-এমপির বিদেশে সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
যাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা ও এমপি সালমান এফ রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল), সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা: দীপু মনি, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী প্রমুখ।
এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও সাবেক ডিবি প্রধান (ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার) হারুন অর রশীদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারসহ ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা অর্ধশতাধিক জনের বিরুদ্ধে বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দুদকের হাতে রয়েছে।
এ ছাড়া সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা: এনামুর রহমান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, খালিদ মাহমুদ, চৌধুরী ফরিদুল হক, ইমরান আহমদ, জাকির হোসেন, কামাল আহমেদ মজুমদার, জাহিদ আহসান রাসেল, নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, শাজাহান খান, কামরুল ইসলাম, হাসানুল হক ইনু, সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, সাবেক এমপি অসীম কুমার উকিল ও তার স্ত্রী যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি অপু উকিল, এমপি জান্নাত আরা হেনরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন, সাবেক সহকারী (পিয়ন) ৪০০ কোটি টাকার মালিক মো: জাহাঙ্গীর, সাবেক মন্ত্রী মো: শাহাব উদ্দিন এবং সাবেক এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, সাবেক এমপি শাহ আলম তালুকদার, সাবেক এমপি ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু ও তার ছেলে সুনাম দেবনাথ, এমপি মো: আবুল কালাম আজাদ, এমপি ডা: মনসুর রহমান, সাবেক মন্ত্রী মো: আব্দুর রহমান, সাবেক এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার, সাবেক এমপি ইকবালুর রহিম, এমপি সাইফুজ্জামান শেখর, মন্ত্রী জিল্লুল হাকিম, সাবেক এমপি তানভীর ইমাম, সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, সাবেক এমপি মো: রফিকুল ইসলাম শিমুল, সাবেক এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয়, সাবেক এমপি মো: এনামুল হক, সাবেক এমপি মো: নিজাম হাজারী, সাবেক মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, সাবেক এমপি মাহবুব আলী, সাবেক এমপি মো: আখতারুজ্জামান বাবুসহ আরো অনেকে অর্থ পাচারে জড়িত।
দুদক সূত্র জানায়, আগে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের জনপ্রিয় গন্তব্য ছিল সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ কিছু দ্বীপরাষ্ট্র। তবে গত কয়েক বছরে অর্থ পাচারের গন্তব্যে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা পূর্ব ইউরোপের মতো দেশগুলোকে অর্থের নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশী পাচারকারীরা।
দুদক সূত্র জানায়, গত ১৫ আগস্ট এস আলম গ্রুপ ও নাফিজ সরাফাতের এবং ২২ আগস্ট সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক।
দুদকের আমলে নেয়া অভিযোগে বলা হয়, দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচিত এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান এবং পদ্মা ব্যাংকের পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত আর্থিক খাত থেকে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতি ও টাকা পাচার করেছেন।
এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে এক লাখ কোটি টাকা পাচার ও ‘দরবেশ খ্যাত’ সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে ৮০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া গত ৪ সেপ্টেম্বর জেনারেল আজিজ আহমেদ, গত ১৮ আগস্ট আছাদুজ্জামান মিয়া ও হারুন অর রশীদ এবং গত ২৫ আগস্ট কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।