
# চিফ ইঞ্জিনিয়ার থাকতেই লুটেপুটে খেয়ে হয়ে উঠেন তেলতাজা
# ছিলেন স্বৈরাচারের দোসর, এখন বিএনপির বড় নেতা
# ঘুরে ফিরে ছাড়েন না চট্টগ্রাম
মুখ ভর্তি দাড়ি, পড়েন নামাজও। সে কারণে যে কেউ প্রথম দেখায় ভাবতে পারেন আল্লাহর অলি। কথা বার্তায়ও খুব পটু। তাতে মনে হবে খুব সহজ সরল একজন স্বজ্জন ব্যক্তি। কিন্তু প্রধান প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় তিনি এক ঠিকাদারের সাথে কমিশনের পারসেন্টিস নিয়ে দর কষাকষির সময় বলেছিলেন-ভাই যা বলছি তাই দিতে হবে, দিলে তাড়াতাড়ি দেন আমি নামাজ পড়তে যাব।
সেই কথার অডিও রেকর্ড এখন সংরক্ষিত দৈনিক ঈশান কর্তৃপক্ষের কাছে। একই সাথে ভুক্তভোগী সেই ঠিকাদারও নিশ্চিত করেছেন বিষয়টি। আর এমন সব কথা থেকে বুঝা যায়, তিনি কোন বংশের অলি। কতটুকুই বা স্বজ্জন।
তাছাড়া তার চালচলনেও রয়েছে আভিজাত্যতা। টাকার চর্বিতে চিক চিক করা চিবুক ও কপাল দেখে সহজে অনুমান করা যায়, তিনি কী পরিমাণ সম্পদের মালিক। এক কথায় তিনি কিছু পারুক আর না পারুক, আখামের বড় খাম্ম (অর্থাৎ দূর্নীতিতে সেরা)।
এমন কথাগুলো বলছিলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের এক সময়ের প্রধান প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীনকে নিয়ে। আর যারা বলছিলেন তারা হলেন-ভুক্তভোগী ঠিকাদার ও রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী। যারা ঘুষ-দূর্নীতিতে অবাধ্য হওয়ায় সুবক্তগীনের কৌশলি হয়রানির শিকার হয়েছেন।
ভুুক্তভোগীদের ভাষ্য, ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম, কমিশন বাণিজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতার নজির সৃষ্টির কারণে গত দুই বছর আগে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে বদলি হন মো. সুবক্তগীন। কিন্তু কাঁচা টাকার জোরে বছর না যেতেই তিনি ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথ প্রকল্পের পরিচালক পদে ফিরে আসেন চট্টগ্রামে।
আবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একইভাবে কাঁচা টাকার জোরে তিনি হয়ে যান রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকও (জিএম)। এই পদোন্নতি নিয়ে রেলওয়ের নানা ধাপের কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমনকি ঠিকাদাররাও অবাক। তাদের প্রশ্ন, একাধিক জেষ্ঠ্য কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে বিতর্কিত কর্মকর্তা মো. সুবক্তগীন কিভাবে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদে পদায়ন পেল। এই পদায়ন কি দূর্নীতির পুরস্কার?
এ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাদের মাঝেও। এমনকি ফ্যাসিবাদের এই দোসরকে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম করায় বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করেছেন রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তাকে সরানো না হলে লাগাতার আন্দোলনে যাওয়ার হুশিয়ারিও দিয়ে রেখেছেন তারা।
ক্ষুব্দ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, মো. সুবক্তগীন রেলওয়ের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তার আগে ১৮তম ব্যাচের আরও চারজন কর্মকর্তা রয়েছেন রেলওয়েতে। যারা রেলওয়ের দ্বিতীয় গ্রেডের এই পদের জন্য যোগ্য, দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
তারা হলেন, মো. ফরিদ উদ্দিন (১৮তম ব্যাচ), সলিমুল্লাহ বাহার (১৮তম ব্যাচ), আহমেদ মাহবুব (১৮তম ব্যাচ), মইনুল ইসলাম (১৮তম ব্যাচ)। এই চার কর্মকর্তাদের সবাই তৃতীয় গ্রেডের। যেখান থেকে দ্বিতীয় গ্রেডের পদ হিসেবে মহাব্যবস্থাপক পদে পদায়ন হওয়ার কথা। কিন্তু এই চার কর্মকর্তার নিচের গ্রেড হয়েও মহাব্যবস্থাপক পদে পদায়ন পেয়ে গেছেন মো. সুবক্তগীন। এতে দূর্নীতিকে উৎসাহ করা হয়েছে বলে মন্তব্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মন্তব্য, বৈষম্য ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও দূর্নীতি কমেনি। অন্তবর্তিকালীন সরকার ক্ষমতায় এসে দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। উল্টো নানাভাবে পদোন্নতি ও ভাল জায়গায় পোস্টিং দিয়ে দূর্নীতিবাজদের পুরুস্কৃত করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার উপসচিব উজ্জ্বল কুমার ঘোষ স্বাক্ষরিত পৃথক প্রজ্ঞাপনে রেলওয়েতে রদবদল করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে সাবেক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী ও চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীনকে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদে পদায়ন করে বদলি করা হয়। এই পদায়নের নেপথ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক লেনদেন ও ভবিষ্যতে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার অঙ্গীকার রয়েছে বলে অভিযোগ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
অন্যদিকে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের আরেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ নাজমুল ইসলামকে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) পদে বদলি করা হয়। আরেক প্রজ্ঞাপনে রাজশাহীর বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) ডা. এসএম মারফুল আলমকে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) পদে বদলি করা হয়। এই রদবদলেও রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক লেনদেন ও ভবিষ্যতে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার অঙ্গীকার।
মহাব্যবস্থাপক পদে পদায়নের কারণে দুর্নীতিতে বাধ্য করা অধীনস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষুব্দ হলেও আবার উল্লাসে মত্ত হয়েছেন ঘুষ-দূর্নীতি অনিয়মে জড়িত কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। রয়েছেন অনৈতিক সুবিধাভোগী ঠিকাদাররাও। যারা দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকে অদ্যাবধি মো. সুবক্তগীনকে ঘিরে রেখে নিয়মিত মধু ঢেলে খাওয়াচ্ছেন।
সুবক্তগীনও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান সারাক্ষণ। নেতাকর্মীদের তিনি এক সময় ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথা শোনান গর্ব করে। যা শুনে দলীয় বিধাতা হিসেবে সর্বাধিক কাজের সুবিধা পাবেন-এমন আশায় হাসির রোল ঝারেন। এ নিয়ে নেতাকর্মীরা বুক ভরা আশা নিয়ে প্রায় বলতে শুনা যায়, গত ১৫ বছর আমরা যা পাইনি, তা এবার পুষিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে। জিএম সাহেব আমাদের দলের লোক।
আর এ নিয়ে ক্ষোভ ঝারেন রাজনীতি থেকে দূরে আছেন এমন অনেক ঠিকাদার। তাদের বলতে শুনা যায়, হায়রে জিএম সাহেব। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে চিফ ইঞ্জিনিয়ার থাকাকালে কত অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। নিজের কমিশন বাণিজ্য ঠিক রাখতে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের কাছে সব কাজ থেকে ৫% কমিশন পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাবরের ছত্রছায়ায় থেকে প্রতিপক্ষ ঠিকাদারদের কত অত্যাচারই না করেছেন। আর পরিস্থিতি বুঝে এখন রুপ পাল্টিয়ে হয়ে গেলেন বিএনপির মস্ত বড় নেতা।
ঠিকাদাররা আরও বলেন, বিগত স্বৈরাচার সরকারের আমলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় বিভিন্ন ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্নসাৎ করার অভিযোগ আছে এই সুবক্তগীনের বিরুদ্ধে। এক প্রকল্পকে একাধিকবার নতুন প্রকল্প হিসেবে দেখিয়ে পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে কাজ করিয়েছেন। বিশেষ করে এপিপির আওতায় এসব ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।
এছাড়া ভুয়া প্রকল্পের কাজ করার জন্য নামে-বেনামে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন সুবক্তগীন। এমনকি প্রকল্পের কাজ ইজিপিতে টেন্ডার দেখালেও ৬ এবং ৭ নম্বর রেটের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে অর্থ হাতিয়েছেন। এরমধ্যে প্রতিবছর কালুরঘাট সেতুসহ বিভিন্ন ব্রিজ-কালভার্ট মেরামত, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভবন সংস্কার, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ২৬টি স্টেশনের ভবনসহ নানা অবকাঠামো সংস্কার ও নির্মাণ, সিআরবি হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের মত শত শত কোটি টাকার প্রকল্প বানিয়ে অর্থ হাতিয়েছেন তিনি। এভাবে লুটেপুটে খেয়ে তিনি হয়ে উঠেন তেলতাজা।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে। এরমধ্যে চট্টগ্রামে একটি বড় ওয়ার্কশপ, একটি ট্রেনিং একাডেমি, লোকোশেডসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আছে। এসব জিএম পূর্বকে দেখভাল করতে হয়। এই জোন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এবং এখানে জটিলতা বেশি থাকায়, দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে বিতর্কিত জিএম সুবক্তগীন অনিয়ম-দুর্নীতিতে আরও দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাবে। যা চালাতে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ঠিকাদার নিয়ে অলরেডি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেছেন তিনি।
অনিয়ম-দুর্নীতির ও স্বৈরাচারের দোসরের বিষয়ে কথা বলার জন্য রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম মো. সুবক্তগীনের মুঠোফোনে সর্বশেষ সোমবার (১৭ মার্চ) দুপুরে ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। এর আগে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কোন রকম সাড়া দেননি। সরাসরি কথা বলার জন্য কার্যালয়ে গেলে দেখা মিলে অবাক কান্ড।
দেখা যায় রাজনৈতিক নেতারা কোন ধরনের অনুমতি ছাড়া হাট-বাজারের মতো কার্যালয়ে প্রবেশ করে সুবক্তগীনের সাথে কথা বলার সুযোগ পেলেও সাংবাদিকরা পান না। জিএম কার্যালয়ে প্রবেশ করতে হলে জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. ফেরদৌস এর মাধ্যমে কর্মরত পত্রিকার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমিত নিতে হয়।
ভিজিডিং কার্ড পৌছানোর পরও সহজে সাক্ষাত জুটে না সাংবাদিকদের। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষার পর পূর্ব থেকে পরিচিত এবং পেশাদারিত্ব নেই এমন সাংবাদিককে প্রবেশের অনুমিত দেওয়া হয়। পেশাদার সাংবাদিক গেলে, জিএম সাহেব নেতা বা ঠিকাদারের সাথে মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন-এমন কথা শুনতে হয় প্রায় সময়। এ অবস্থায় কথা বলার সুযোগ না পেয়ে অনেক সাংবাদিক ফিরে যান।
অনিয়ম-দূর্নীতি নিয়ে কথা বলতে গত জানুয়ারি মাসে ৩ বার, ফেব্রুয়ারি মাসে ৩ বার কার্যালয়ে যান দৈনিক ঈশানের এই প্রতিবেদক। অনেকক্ষন অপেক্ষার পর এই প্রতিবেদক কোনবারই কার্যালয়ে প্রবেশের অনুমতি পায়নি। তবে অফিস থেকে চলে যাওয়ার পথে ২ বার কথা বলার সুযোগ হয় জিএম সুবক্তগীনের সাথে। কিন্তু প্রতিবারই হাতে সময় নেই, আরেকদিন আসার কথা বলে চলে যান তিনি।
সর্বশেষ মার্চ মাসের শুরুর দিকে সাক্ষাত হলে হাতে সময় নেই বলে ফোনে কথা হবে বলে দ্রুত অফিসস্থল ত্যাগ করেন। এরপর এ পর্যন্ত ৪-৫ বার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
একই পরিস্থিতি রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) আফজাল হোসেনের ক্ষেত্রেও। এ বিষয়ে কথা বলতে ডিজির ব্যবহৃত মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কল রিসিভ করেনি। এ যেন হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রীর মতো।
(বিঃ দ্রঃ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম মো. সুবক্তগীনের অনিয়ম-দূর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম কিস্তি প্রকাশ হলো। দ্বিতীয় কিস্তি আসছে শীগগীরই। প্রিয় পাঠক চোখ রাখুন দৈনিক ঈশানে)