
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে সারাদেশের মতো গত এক সপ্তাহ ধরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল চট্টগ্রামে। এখনো আতঙ্ক সাথে নিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে চট্টগ্রামের। সচল হচ্ছে বিভিন্ন এলাকা।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষ, গোলাগুলি ও হানাহানিতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে চট্টগ্রামের মানুষ। এরপর গত এক সপ্তাহ ধরে স্বচক্ষে দেখেছে ঘটে যাওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলকারী শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ ও পুলিশ-বিজিবির অ্যাকশন।
ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, চাপাতি-রাম দা নিয়ে হামলা, গুলিবর্ষণ, কেউ কেউ দেখেছেন ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যাকান্ডও। এর বাইরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে কারফিউ ও সেনাবাহিনীর তৎপরতা। যা নতুন প্রজম্ম এর আগেও কখনো দেখেনি।
তবে একাত্তরের বয়োজেষ্ঠ্যরা বলছেন, এমন আন্দোলন ও পুলিশ-বিজিবি-সেনাবাহিনীর অ্যাকশন এর আগে স্বৈরাচার এরশাদের আমলে দেখেছেন। সে সময় আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত যৌথভাবে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন চালিয়েছিল। যে আন্দোলনে স্বাধীনতা পরবর্তি চট্টগ্রামের মানুষ দেখেছে ধ্বংসলীলা। দেখেছে নির্বিচার গুলি চালিয়ে আন্দোলনকারীদের হত্যার দৃশ্য। সেই দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে এবার।
গত এক সপ্তাহে যা ঘটেছিল চট্টগ্রামে :
চট্টগ্রাম মহানগরীর পাঁচলাইশ থানার মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা ও মুরাদপুর এলাকার কোকারিজ ব্যবসায়ী হাজী নজরুল ইসলাম (৬৭) বলেন, গত ১৬ জুলাই মঙ্গলবার থেকে চট্টগ্রামে শুরু হয় কোটা সংস্কার অন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। বিশেষ করে চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট থেকে টাইগারপাস এলাকায় এই বিক্ষোভ শুরু হয়।
আন্দোলকারীরা নিজ নিজ গতিতে বিক্ষোভ করলেও বাঁধ সাধে পুলিশ। সেই থেকে উত্তপ্ত হতে শুরু করে নগরীর সার্বিক পরিস্থিতি। ১৭ জুলাই বুধবার আশুরার দিনেও বিক্ষোভে বাধা সৃষ্টি করে পুলিশ। এ সময় পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এতে আহত হয় কয়েকজন শিক্ষার্থী।
১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি নিয়ে নামে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু দুপুরের দিকে পুলিশের সহযোগীতায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী কতিপয় দূর্বৃত্ত। যারা এ দিন পিটিয়ে ও গুলি করে আন্দোলনকারী তিন শিক্ষার্থীকে হত্যা করে।
এরা হলেন, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়াসিম আকরাম (২৪) ফার্নিচার দোকানের কর্মচারি ফারুক (৩২), ওমরগণি এমইএস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল। এছাড়া প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে আহত করা হয়। আর এতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি।
মঈনুদ্দিন সোহেল (৫৮) নামে নাসিরাবাদ এলাকার আরেক বাসিন্দা জানান, সেদিন পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের গুলি করে। শিক্ষার্থীরা প্রাণভয়ে বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নিয়েও রেহাই পায়নি। তাদেরকে লোহার রড ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারাত্নকভাবে আহত করে।
এরপর নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরা পাািলয়ে গেলেও বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ষোলশহর দুই নম্বর গেইট, জিইিসির মোড়ে বিক্ষোভ করে। আর থেমে থেমে গুলি বর্ষণ ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে এ সময় আকতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে কয়েক হাজার গাড়ি আটকা পড়ে। এতে ব্যাপক দুর্ভোগে পড়ে নগরবাসী।
এরপর সন্ধ্যা ৭টার দিকে শুরু হয় গোলাগুলি। এ সময় নগরীর চান্দগাও আবাসিক থেকে জিইসির মোড় পর্যন্ত মুহর্মুহু শোনা যায় সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, গুলি বর্ষণের শব্দ। দেখা যায় আগুনের গোলা ও অগ্নিকুন্ডলী। এভাবে রাত ১টা পর্যন্ত চলে। তখন কে কার উপর গুলি বর্ষণ করছে তাও বলা ছিল মুশকিল।
কারণ এই যুদ্ধের আগ মুহুর্তে এসব এলাকায় নিভিয়ে দেয়া হয় সবধরণের সড়কবাতি। অন্ধকারে তখন মনে হয়েছিল যেন আরেকটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। এ সময় নগরীর মানুষ চরমভাবে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এরপর রাতেই চট্টগ্রামে নামে র্যাব ও বিজিবি।
পরদিন শুক্রবার সকাল ১০ টা ২০ মিনিটে নগরীর কর্ণফুলী নতুন ব্রিজ এলাকা দখলে নেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। সেদিন ছিল কমপ্লিট শাটডাউনের দ্বিতীয় দিন। পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির বাঁধার পর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও গুলি বর্ষণে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় সেই এলাকা।
দুপুরে জুমা‘র নামাজের পর শুরু হয় নগরীর আন্দরকিল্লা ও বহদ্দারহাট এলাকায় ভাঙচুর। এ সময় শুরু হয় পুলিশের সাধে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এক পর্যায়ে সন্ধ্যার দিকে নগরীর চান্দগাঁও থানায় হামলার চেষ্টা চালানো হয়। এ সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হয় দুই জন। এর মধ্যে একজনের নাম তানভীর বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি ছিলেন কলেজছাত্র। অন্যদিকে নিহত অপরজন বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ২২ বছর বয়সী ওই তরুণের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এ ঘটনার পর রাতেই নামে সেনাবাহিনী।
শনিবার (২০ জুলাই) সকালে ঘুম থেকে উঠে নগরীর মোড়ে মোড়ে সেনাবাহিনীর আনা-গোনা দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠে নগরীর মানুষ। ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় সেনা সদস্যদের বাধার মুখে শুনতে পায় কারফিউ জারির কথা। পরে বিষয়টি মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্ক যেন ঘিরে ধরে নগরবাসীকে। সেই থেকে প্রায় ফাঁকা হয়ে পড়ে সড়ক-মহাসড়ক।
এ বস্থায় ২১ জুলাই রবিবার সকাল বেলা থেকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকলেও কোটা সংস্কার নিয়ে হাইকোর্টের আপীল বিভাগের রায়ের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ২২ জুলাই সোমবার থেকে পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হয়। যদিও আজ ২৪ জুলাই বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত এবং বিকাল ৫টা থেকে এখনো কারফিউ বলবৎ রয়েছে। ফলে কখন কি হয়? এমন একটা আতঙ্ক চট্টগ্রামের মানুষের মনে।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রামের মানুষ যা দেখেছে, তা বুলতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। এরপরও পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছৃু স্বভাবিক হতে সময় লাগবে। কারণ নগরে পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযান চলছে। এ নিয়েও মানুষ ও শিক্ষার্র্থীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় শুধু চট্টগ্রাম নগরবাসী নয়, পুরো পুলিশ প্রশাসনও রয়েছে। কারণ গত কয়েকদিনে চট্টগ্রামে থানায় থানায় পুলিশ বক্সে হামলা হয়েছে। পুলিশ-র্যাব-বিজিবির উপর গুলিবর্ষণ হয়েছে। রাষ্ট্রিয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হামলা হয়েছে। তবে এ হামলায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা নয়, তৃতীয় পক্ষ এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব ঘটনায় পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে। অপরাধীদেও গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।