চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) কাছে আবাসনের নামে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা এলাকায় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) মাধ্যমে সংরক্ষিত বনের পাহাড় বিক্রি করে ৩৮ কোটি টাকা পকেটে ভরার মহা আয়োজন করেছিলেন সদ্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
এ জন্য জাগৃককে প্রকল্প নেওয়া থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়েছেন তিনি। পাহাড়ের জমির আমমোক্তারনামাও নেওয়া হয়েছিল চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের ঠিকানায় এক ব্যক্তির নামে। এর আগে আবাসিক এলাকায় ১৯৫ প্লটের জন্য এলাকাবাসীর অনেকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। কিন্তু এখনও প্লট পাননি কেউ।
আর টাকা হাতানোর কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন হাছান মাহমুদের ভাই খালেদ মাহমুদ, এরশাদ মাহমুদ, পিএ ইমরুল করিম রাশেদ, এনায়েতুর রহিমসহ আরও কয়েকজন। যারা গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আত্নগোপনে রয়েছেন। জাগৃকের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র বলেছে, প্রকল্প এলাকার ৭০ শতাংশই পাহাড় ও ৩০ শতাংশ জলাধার হওয়ায় বিভিন্ন সংস্থার আপত্তিতে এই প্রকল্প প্রথমে বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু হাছান মাহমুদের চাপে আগের মতামত বাদ দিয়ে নতুন করে প্রকল্প অনুমোদন করানো হয়। প্রাথমিক কাজও শুরু হয়।
প্রকল্পটি হলো ‘চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প।’ যা ছিল ড. হাছান মাহমুদের নির্বাচনী এলাকা। সূত্র জানায়, হাছান মাহমুদ ২০১৪ সালের ১০ জুলাই রাঙ্গুনিয়ায় ওই আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি আধা সরকারি পত্র (ডিও) দেন। তাঁর প্রভাবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন জাগৃক প্রকল্পটি নেয়। তবে প্রকল্প এলাকার ৭০ শতাংশ পাহাড় ও ৩০ শতাংশ জলাধার থাকায় শুরুতেই আপত্তি জানায় নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং পরিবেশ অধিদপ্তর।
মতামত চাইলে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের সিনিয়র প্ল্যানার শাহীন আহম্মেদ চিঠিতে জানান, ভূমি ব্যবহারের স্থান হিসেবে চিহ্নিত দাগটি ‘বিশেষ সংরক্ষিত’ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এটি প্রকল্পের জন্য উপযুক্ত জায়গা নয়।
নথি থেকে জানা যায়, মতামতে পরিবেশ অধিদপ্তর বলে, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ১৬ দশমিক ৩২ একরের মধ্যে ১৫ একর টিলা শ্রেণির। আইন অনুযায়ী, সরকারি, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় বা টিলা কর্তন বা মোচন করা যাবে না।
পরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমডি) পৃথক মূল্যায়নে বলা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে পাহাড় কাটতে হবে। প্রকল্প এলাকার সীমানার ভেতর প্রায় ৭০ শতাংশ স্থানে ছোট ছোট পাহাড় এবং ৩০ শতাংশে প্রাকৃতিক জলাধার রয়েছে। জলাধারের পাশে কৃষিজমি আছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এলাকায় অনেক ছোট ছোট জলাধার পরিবর্তনে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সূত্র জানায়, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডও আপত্তি জানায়। মতামতে পিজিসিবি বলেছে, তাদের সঞ্চালন লাইনের টাওয়ার যে পাহাড়ে সেটি থেকে মাটি কাটা যাবে না। টাওয়ারের পাদদেশে কোনো অতিরিক্ত মাটিও ভরাট করা যাবে না। প্রকল্প এলাকায় ১৩২ কিলোভোল্টের জাতীয় গ্রিড লাইন গেছে। সব বিষয় উল্লেখ করে প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হলে তিনি অনুশাসনে লেখেন, ‘জলাভূমি সংরক্ষণ করতে হবে; পাহাড় কাটা যাবে না।’ এ সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর পূর্ত সচিবের নেতৃত্বে প্রকল্প সমাপ্তবিষয়ক সভা করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়।
সূত্র মতে, নিয়ম অনুযায়ী এখানেই প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ ও দপ্তরকে নতুন করে মতামত দিতে বলা হয়। সেখানে হাছান মাহমুদের ইচ্ছেতে কৌশলে আগের মতামত বাদ দেওয়া হয়। পরে ২০২০ সালের মার্চে প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। প্রকল্পে ১৬ দশমিক ১৯ একর জমি ধরা হলেও ১৪ দশমিক ১৯ একরে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৪১ কোটি ৮৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৩৮ কোটি টাকাই ভূমি অধিগ্রহণের জন্য। যা হাতানোর চেষ্টায় ছিলেন হাছান মাহমুদ।
প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই প্রকল্প জাগৃক নিতে চায়নি। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ হাছান মাহমুদের চাপে কর্তৃপক্ষ তাঁর নির্বাচনী এলাকায় এ প্রকল্প নেয়। সব সংস্থার আপত্তি, এমনকি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বাতিল করার পরও প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে তাঁর চাপে। মূলত প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের ৩৮ কোটি টাকার বেশির ভাগ হাতিয়ে নিতে ছক করা হয়। এর অংশ হিসেবে বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ নুরু উদ্দীন ওই পাহাড়ের জমির আমমোক্তারনামা নেন।
প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা দেওয়া হয়, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের ১৮/১৯, মদিনা মার্কেট, হোটেল দুবাই (২য় তলা)। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসন ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম শুরু করলে এই ভুয়া মালিকানা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে অধিগ্রহণের টাকার বেশির ভাগ নিতেই সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল।
জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব মো. নবীরুল ইসলাম বলেন, ‘বাতিল হওয়া প্রকল্প আবার নেওয়ার কথা নয়। বিস্তারিত খোঁজ নেব।’
বিষয়টি নিয়ে জাগৃকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হামিদুল ইসলাম খান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রসঙ্গত, প্রকল্প এলাকা রাঙ্গুনিয়া হাছান মাহমুদের নির্বাচনি এলাকা। আগেরবার তিনি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী থাকলেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর দুবাই পালিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকায় হযরত বিমান বন্দর থেকে আটক করা হয়। তিনি বর্তমানে সেনা হেফাজতে জামাই আদরে রয়েছেন।