
- চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ইদ্রিস মিয়ার মাধ্যমে গত চার মাস আগে বিএনপির কেন্দ্রীয় ওই তরুণ নেতার সঙ্গে চট্টগ্রামে সাক্ষাৎ হয়। সেখানে অবিশ্বাস্য অংকের টাকার বিনিময়ে সুমনকে প্রটেকশন দিতে সম্মত হন বিএনপির ওই নেতা।
একদিকে হত্যা মামলা, অন্যদিকে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে দেড় হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ। আছে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারে মধ্যস্থতার অভিযোগ। হয়েছেন গ্রেপ্তারও। কিন্তু বিস্ময়করভাবে আবার জামিনে বেরিয়েও গেছেন চট্টগ্রামের মাফিয়া ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাত সাইফুল ইসলাম সুমন।
তার জামিন থেকে শুরু করে নিরাপদে দেশ ছাড়ার পুরো ‘ঠিকাদারি’ নিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় এক তরুণ নেতা। যার বিরুদ্ধে গত কয়েক মাসে মামলাবাণিজ্য, পদবাণিজ্য, দখলবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দা এই সাইফুল ইসলাম সুমন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহ–সভাপতি ইদ্রিস মিয়ার ভাইয়ের ছেলে। যার মাধ্যমে সখ্যতা গড়ে উঠা বিএনপির কেন্দ্রীয় এক তরুণ নেতার। যার প্রভাবে ঢাকা বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হওয়া সুমন জামিনে বেরিয়ে এখন সীমান্ত পথে দেশ ছেড়ে পালানোর অপেক্ষায় রয়েছেন।
সুমনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এমন একজন এ তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ভাই ইউসিবি ব্যাংকের পদচ্যূত পরিচালক আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সাইফুল ইসলাম সুমন।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সুমন বড় অংকের একটি অনুদানও দেন আওয়ামী লীগকে। এই সুবাদে তিনি অন্তত দুইবার সরাসরি দেখা করেছেন ক্ষমতাচ্যূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও।
ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান সুমন। এর আগে চট্টগ্রামে ছাত্রজনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমাতে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগসহ অন্য অঙ্গসংগঠনগুলো যে টাকা খরচ করেছে, তার অর্ধেক টাকাই যোগান দেন আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী সুমন।
তার অর্থের উৎস ছিল চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জভিত্তিক এসএস ট্রেডিং ও শাকিল এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকও সাইফুল ইসলাম সুমন।
জানা গেছে, সাইফুল ইসলাম সুমনের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অর্থায়ন ছাড়াও দুটি হত্যামামলার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এর পরও অবিশ্বাস্য কৌশলে ঘাটে ঘাটে টাকা ঢেলে তিনি প্রথমে ঢাকা বিমানবন্দর হয়ে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেন। এর পরও রোববার (৫ জানুয়ারি) রাতে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশ সুমনকে নাটকীয়ভাবে গ্রেপ্তার করে।
ঢাকা বিমানবন্দর থানা সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সুমনের বিরুদ্ধে হওয়া অন্তত একটি মামলার তথ্য পাওয়ার পরও তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। পরদিন সোমবার (৬ জানুয়ারি) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) অস্বাভাবিক গোপনীয়তায় সুমনকে হাজির করা হয় ঢাকার একটি আদালতে।
বিদেশ থেকে কলকাঠি নাড়তে থাকা বিএনপির কেন্দ্রীয় ওই তরুণ নেতার নির্দেশনায় প্রশাসনের বিভিন্ন মহল থেকে চট্টগ্রামের তিনটি থানার ওসিদের ওপর চাপ তৈরি করা হয়, যেন তারা সুমনের মামলার কোনো ফাইল ঢাকায় না পাঠান অথবা পাঠালেও যেন দেরি করে পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম থেকে সদ্য বদলি হওয়া গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তাও সুমনের পক্ষে তৎপর ছিলেন।
শেষ পর্যন্ত মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অস্বাভাবিক দ্রুততায় ঢাকার একটি আদালত থেকে জামিন পেয়ে যান সুমন। শ্যোন অ্যারেস্টের আবেদন ও সুনির্দিষ্ট মামলার রেফারেন্স থাকার পরও সুমনের জামিন পাওয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট একাধিক আইনজীবী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন বলেন, সুমনের জামিনকে কেন্দ্র করে আদালতপাড়ায় রীতিমতো উৎসবের আমেজ ছিল। আমরা শুনেছি, জামিন নেওয়ার প্রতিটি ধাপে থানা থেকে আদালত পর্যন্ত বিভিন্নভাবে সুমনের কাছ থেকে দফায় দফায় টাকা হাতিয়েছেন এক বিএনপি নেতা। জামিনে বেরুনোর পর সুমন চলে যান অজ্ঞাত স্থানে। এখন তিনি বিমানবন্দর বা সীমান্ত পথ— যে কোনো উপায়ে দেশ ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
জানা গেছে, সুমনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে ছাত্রজনতার আন্দোলন চলাকালে সহিংসতা, সহিংসতায় অর্থ যোগানো, পুলিশের ওপর হামলা, চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও, হাটহাজারীসহ অন্তত পাঁচটি থানায় মামলা রয়েছে। এর মধ্যে চান্দগাঁও ও হাটহাজারী থানায় রয়েছে হত্যা মামলা। এছাড়া পটিয়া থানায়ও আছে মামলা। ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার ঘটনায়ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বিস্ময়ের ব্যাপার চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানায় সুমনের বিরুদ্ধে হত্যামামলা থাকার পরও ১০ দিন আগে গত ৫ জানুয়ারি ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়া সুমন সম্পর্কে কোনো তথ্য জানেন না ওই থানার ওসি আফতাব উদ্দিন। তিনি বলেন, ঢাকায় সুমনের মামলার ‘রিকুইজিশন’ পাঠানো হয়েছে। তবে সুমনের গ্রেপ্তার হওয়ার পরদিন পর্যন্ত ঢাকায় কিছু পৌঁছায়নি। তার আগেই সুমনের জামিন হয়ে যায়।
পাঁচলাইশ থানার ওসি মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, সাইফুল ইসলাম সুমনের বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা আছে। বিমানবন্দরে সুমন গ্রেপ্তার হওয়ার রিকুইজিশন দেওয়ার পর তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরদিন আমরা তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট করি। তবে সুমনের জামিন সম্পর্কে তিনি কিছুই জানে না বলে জানান।
সুমনের বিরুদ্ধে হাটহাজারী মডেল থানায়ও একটি হত্যামামলা রয়েছে। এরপরও ওই থানার ওসি আবু কাওসার মোহাম্মদ হোসেন সেটি মনে করতে পারছেন না বলে জানান। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুমন গ্রেপ্তার হওয়ার পর হাটহাজারী থানা থেকেও রিকুইজিশন পাঠানো হয়েছিল ঢাকায়, তবে সেটাও পাঠানো হয় দেরিতে।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর সুমনকে ধরার জন্য অভিযান চালিয়েছিল পটিয়া থানা পুলিশ। অভিযানের খবর পেয়ে আত্মগোপনে থাকা সুমন বিএনপির কেন্দ্রীয় এক তরুণ নেতার মাধ্যমে পটিয়া থানার ওসিকে অন্যত্র বদলির জন্য তদবির শুরু করেন। ওই সূত্র দাবি করেছেন, বদলির আদেশ কাটাতে সুমনের সঙ্গে আপোষে যেতে বাধ্য হন ওসি। এরপর থেকে ওসি আর সুমনকে ঘাটাতে সাহস করেনি।
সুমনের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ইদ্রিস মিয়ার মাধ্যমে গত চার মাস আগে বিএনপির কেন্দ্রীয় ওই তরুণ নেতার সঙ্গে চট্টগ্রামে সাক্ষাৎ হয়। সেখানে অবিশ্বাস্য অংকের টাকার বিনিময়ে সুমনকে প্রটেকশন দিতে সম্মত হন বিএনপির ওই নেতা।
তিনিই ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সুমনকে বিদেশ পালানোর সবরকম ব্যবস্থা করে দেন। যদিও দুই দিন আগে তিনি বিদেশে চলে যান। চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দা সুমন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহ–সভাপতি ইদ্রিস মিয়ার ভাইয়ের ছেলে। ইদ্রিস মিয়াকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতির পদ পাইয়ে দিতেও বিএনপির ওই নেতাকে সুমন দেড় কোটি টাকা দেন বলে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ঝড় ওঠে।
তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি। মুঠোফোন রিসিভ না করায় ইদ্রিস মিয়ার সাথে এ বিষয়ে কথা বলাও সম্ভব হয়নি।