ইন্টার্ন কেমিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ (ইসিআই) লিমিটেড। দেশে উন্নত মানের ফরমালিন উৎপাদনকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় যার অবস্থান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে যে প্রতিষ্ঠানে কখনো হয়নি লোকসান। কিন্তু নানা অনিয়ম-দূর্নীতিতে লুটপাটের কারণে গত ১৫ বছর লোকসান দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে গলাটিপে হত্যা করে আওয়ামী লীগ সরকার।
আর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধি আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেখানে প্রতিষ্টানটির দাফনের কাফন পর্যন্ত খুলে লুটে নিচ্ছে বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীরা। যারা প্রতিষ্ঠানটির মূল্যবান মেশিনারী যন্ত্রপাতি এখন র্স্ক্রাপ বানিয়ে লুট করছে কোটি কোটি টাকা।
অভিযোগ উঠেছে, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের এই মিলটির মূল্যবান যন্ত্রপাতি মাত্র ১.৯ কোটি টাকায় নিলামে বিক্রি করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। অথচ এসব যন্ত্রপাতির বর্তমান বাজার মূল্য ২০ কোটি টাকারও বেশি। এতে হরিলুট হচ্ছে অন্তত ১৮ কোটি টাকা। এর পেছনে কলকাঠি নাড়িয়েছে রাঙ্গুনিয়ার তৎকালীন সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ স¤পাদক, সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
তারই ইচ্ছায় হাছান মাহমুদের পৈত্রিক জন্মস্থান পটিয়া উপজেলার বাসিন্দার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সজীব এন্টারপ্রাইজ এ কাজের টেন্ডার ভাগিয়ে নেয়। হাছান মাহমুদের প্রভাবে টেন্ডার আহ্বানেও মানা হয়নি কোন রকম নিয়মনীতি। গুটি কয়েক কর্মকর্তার কারিশমায় মূল্যবান মেশিনারী যন্ত্রপাতি নিলামে বিক্রি করা হয় প্রকৃত বাজার মুল্যের ১০ ভাগের এক ভাগ দামে। তবে ক্ষমতা পালাবদলের পর প্রতিষ্ঠানটির যন্ত্রপাতি সরানো কঠিন হয়ে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির জন্য।
শেষ মেষ রাঙ্গুনিয়া উপজেলা বিএনপির একাংশের কতিপয় নেতাকর্মীদের ভাগ দিয়ে মিলের মালামাল সরানো শুরু করে। মিলের মুল গেইট বন্ধ রেখে কড়া প্রহরায় দিবারাত্রি চলছে মালামাল সরিয়ে ফেলার মহাযজ্ঞ। গত মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) সরেজমিনে দেখা যায়, মিলের ভেতরে বিশাল আকৃতির ট্যাংক, বয়লার, বৈদ্যুতিক ট্রান্সপাওয়ার, গ্যাস সিলিন্ডার, ভারি ই¯পাত ও লোহার পাতসহ সকল বিভাগের মেশিনারী যন্ত্রপাতি বড় বড় ট্রাকে করে লোডিং আর আউটিং কাজ চলছে।
মিলের গেইটে থাকা আনসার সদস্যরা এ বিষয়ে মুখ না খুললেও স্থানীয় লোকজন জানান, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ৪-৫ ট্রাক মালামাল দেদারসে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। চট্টগ্রামের সাগরিকায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সজীব এন্টাপ্রাইজের ডিপোতে এই মালামাল নেয়া হচ্ছে। রাঙ্গুনিয়া পৌর বিএনপির নেতা মো. সেকান্দর হোসেনের নেতৃত্বে কতিপয় নেতাকর্মী এ কাজে সরাসরি যোগান দিচ্ছে।
জানতে চাইলে বিষয়টি স্বীকার করেছেন রাঙ্গুনিয়া পৌর বিএনপি নেতা মো. সেকান্দর হোসেনও। তিনি বলেন, টেন্ডারটি আওয়ামী লীগ আমলের। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক ইঞ্জিনিয়ার শামসুল ইসলাম শামসু, পৌর কাউন্সিলর জালাল উদ্দিন, হাছান মাহমুদের ক্যাশিয়ার এমরুল করিম রাশেদ ও কায়ছারের দখলে ছিল এই টেন্ডার কাজ। কিন্তু গত ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাবার পর কাজটা আমরা নিয়েছি। আমরা সবাই মিলে যৌথভাবে কাজটি করছি।
সেকান্দর হোসেন আরও বলেন, টেন্ডারটি পেয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরের সাগরিকাস্থ সজীব এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্টান। প্রতিষ্টানটির মালিক ড. হাছান মাহমুদের পৈত্রিক জন্মস্থান পটিয়ার। আমরা তার কাছ থেকে ৫০% কাজ ভাগ নিয়েছি। আমাদের সাথে বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী জড়িত। যাদের মধ্যে বেতাগী ইউনিয়নের ভাগে ১০%, পোমরায় ১০%, নোয়াগাঁওয়ে ১০%, আমি নিজে ১০% ও সরফাভাটার ইসমাইলের ভাগে রয়েছে ১০%। ইসমাইল এখন বিদেশে। তার কর্মীরা কাজে যুক্ত থেকে দেখা শুনা করছেন।
তবে উল্টো কথা বলেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, বিএনপির কাউকে আমরা কাজ ভাগ দেয়নি। কেউ কাজ ভাগের কথা মুখে বললে তো হবে না। আমরা নিজেদের কাজ নিজেরা করছি। টেন্ডারের নিয়ম মোতাবেক কাজ করছি। এতে কোন অনিয়ম বা লুটপাটের কিছুই নেই।
এ বিষয়ে কথা বলতে ইস্টার্ন কেমিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজে গেলেও উর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতিনিধি রুহুল আমীনের কাছে জানতে চাইলেও এ ব্যাপারে তিনি কিছু বলতেই নারাজ। তবে মিলের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইস্টার্ন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ বিক্রির টেন্ডার আহ্বানে কোন নিয়মনীতি মানা হয়নি। খোজাখুজি করে কোন সুনিদিষ্ট কাগজপত্র শিল্প মন্ত্রণালয়েও পাওয়া যায়নি। সকল নিয়মনীতি উপেক্ষা করা হয়েছে। গুটি কয়েক কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে এত কম দামে মেশিনারী যন্ত্রপাতি নিলামে বিক্রি করা হয়েছে, তাহা খোদ মন্ত্রণালয় পর্যন্ত জানেনা।
এদিকে আক্ষেপ করে ইস্টার্ন কেমিক্যালে চাকুরি করা এক শ্রমিকের ভাষ্য, এই মিলের টেন্ডার হাওয়া মালামালের পরিমান প্রায় ২০ কোটি টাকার উপরে। কেন বা কারা এত অল্প টাকায় কিনে নিল তা ভাবতে অবাক লাগে। মিলের ট্রান্সমিটার ও ২টি গাড়ি রয়েছে যা স¤পূর্ণ নতুন। রয়েছে আড়াই কোটি টাকার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল। মিলের ১০ একর জমি ছাড়াও আরো রয়েছে মিলের ১৫ একর পাহাড় ভূমি। মিলের যন্ত্রপাতি ও কাচাঁমাল বিক্রি না করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করে মিলটি চালু করা হলে যেমনি মানুষের কর্মসংস্থান হতো তেমনি সরকারের লাভজনক শিল্প প্রতিষ্টান হিসেবে পুনরায় উজ্জীবিত হতো। এই মিল বন্ধের কারণে ৪ জন কর্মকর্তা, ২৪ জন কর্মচারি ১২ জন শ্রমিক ও ৫০ জন অস্থায়ী শ্রমিক মিলিয়ে প্রায় শতাধিক পরিবারের শান্তি চিরদিনের জন্য ফুরিয়ে গেল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে বাওয়ালি গ্রুপের প্রতিষ্ঠিত মিলটি ১৯৭৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ন্যস্ত হয়। রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার নোয়াগাঁও এলাকায় ১০ দশমিক এক একর ভূমির উপর এই শিল্প প্রতিষ্টানের পাশে রয়েছে নিজস্ব আরও ১৫ একর পাহাড়ি ভূমি।
তাছাড়া চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় ইস্টার্ন ক্যামিকেলের ১৯ ও ২৪ শতাংশের ২টি প্লট আছে। একটি ডেভেলপার কো¤পানীর মাধ্যমে ১৯ ও ২৯ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কো¤পানি থেকে জামানত হিসেবে প্রাপ্ত ১৫ কোটি টাকার ফান্ড রয়েছে। ব্যাংক থেকে সে টাকায় ৮ শতাংশ হারে লভ্যাংশ পাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট।
সংশ্লিষ্টদের অভিমত, দেশের একমাত্র ফরমালিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্টান এই ইস্টার্ন কেমিক্যাল। এটি বিদেশ থেকে মিথানল আমদানি করে উন্নতমানের ফরমালিন উৎপাদন করত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মিলটি কখনো লোকসানের মুখ দেখেনি। ২০১৭ সালেও গড়ে মাসিক উৎপাদিত মালামাল বিক্রি করে এ মিল ২২ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন করেছিল।
কিন্তুব্যাক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্টানের ইন্ধনে মিলটি বন্ধ করতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে একটি সিন্ডিকেট। একপর্যায়ে ২০১৬ সাল থেকে মিথানল আমদানি বন্ধ করে দেয় চক্রটি। এরপরও প্যারা ফরমালিন আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটির ইউরিয়া ফর্মালডিহাইড এডহেসিভ, ইউরিয়া ফর্মালডিহাইভ ক¤পাউন্ড পাউডার ইউনিট ২টি চালু রাখে।
আর সেই থেকে প্রতিষ্টানটি লোকসান গুনতে শুরু করে। পরবর্তিতে ইস্টার্ন ক্যামিকেলের প্রধান ও উপ-ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হারুন ২০১৮ সালের ২১ জুন স্বাক্ষরিত পত্রে মিল বন্ধের ঘোষণা কার্যকর হয়। পরে ড. হাছান মাহমুদের প্রভাবে ট্রাস্টের উচ্চ পর্যায়ের একটি সিন্ডিকেট সভা করে ২০১৮ সালের ৩০ জুন বহু তদবিরের পর নিলাম টেন্ডারের লক্ষ্যে পৌছে যায়।
এ সময় হাছান মাহমুদের বিশ্বস্ত নেতা ইঞ্জিনিয়ার শামসু- কাউন্সিলর জালাল, ক্যাশিয়ার এমরুল করিম রাশেদ ও কায়ছারের হাত দিয়ে শুরু হয় টেন্ডার প্রক্রিয়া। সেই টেন্ডার ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই কোটা আন্দোলনের মধ্যে তড়িঘিড়ি করে প্রকাশ করা হয়। যার নিয়মনীতি উপেক্ষা করে টেন্ডার ভাগিয়ে নেয় সজীব এন্টারপ্রাইজ। তবে ৫ আগষ্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের হোমরা-চোমরারা পালিয়ে গেলে তা সহজে চলে যায় বিএনপির একাংশের নেতাদের সিন্ডিকেটের হাতে। যা নিয়ে অস্থিরতা চলছে বিএনপির আরেকাংশের নেতাকর্মীদের মাঝে।
ঈশান/খম/সুম