বৃহস্পতিবার- ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫

১১ বছরে দেয়নি একটি টাকাও, তবুও ছিল নিয়মিত ঋণী

এখন ঋণখেলাপি হবে পলাতক হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রী

সরকার পতনে হাঁফ ছেড়েছে রূপালী ব্যাংক

এখন ঋণখেলাপি হবে পলাতক হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রী
print news

বাংলাদেশ ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে ২০১১ সালে সরকার যে ৩৪টি ট্রলারের লাইসেন্স দেয়, তার একটি পান হাছান মাহমুদ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রথমে তিনি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং ২০১১ সালে মন্ত্রী হন। সরকারের মন্ত্রী থাকায় বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস ট্রলারের লাইসেন্স নেওয়া হয় তাঁর স্ত্রী নুরান ফাতেমার নামে।

ট্রলারটির নির্মাণ ব্যয় ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা দেখিয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ১২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা অনুমোদন করে রূপালী ব্যাংক। তিন কিস্তিতে ১১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ছাড় করে ব্যাংক। ২০১৪ সালের অক্টোবরে ট্রলারটির নির্মাণ শেষ হয়। এরপর ইঞ্জিনে ত্রুটিসহ নানা অজুহাতে আজ পর্যন্ত ১ টাকাও শোধ করেননি। কিস্তি পরিশোধের সময় এলেই কোনো ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই প্রভাব খাটিয়ে পুনঃতপশিল করিয়ে নিয়েছেন।  নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সুদ মওকুফ করে নিয়েছেন কয়েকদফা।

অথচ কোনো ঋণে সুদ মওকুফের জন্য ঋণগ্রহীতার মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, মড়ক, নদীভাঙন, দুর্দশাজনিত কারণের শর্ত থাকলেও তা না মেনেই এই সুবিধা দেওয়া হয়। এই সুবিধায় অংশ নিয়েছেন তিনটি সংসদ নির্বাচনে। সেই ঋণে এখন ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১৯ কোটি ৩ লাখ টাকা। সরকার পতনের পর নতুন করে আর সুবিধা না দেওয়ায় শিগগির এ ঋণ খেলাপিতে পরিণত হবে।

এমন তথ্য জানিয়েছেন রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে তাঁকে সুবিধা দিয়ে ঋণটি নিয়মিত দেখানো হয়েছে। আমি এমডি হওয়ার পর আয় খাতে নেওয়া হয়েছে– এমন সুদ নতুন করে আবার মওকুফের জন্য নানাভাবে ব্যাংকের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। তবে সুদ মওকুফ করা হয়নি। গণঅভ্যূত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পলাতক অবস্থায় গত ১১ আগস্ট তাঁর অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। ফলে এখন যে পরিস্থিতি, তাতে এ ঋণ খেলাপি হয়ে যাবে।’

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

ব্যাংকের দেয়া তথ্যমতে, শুরুতে ইঞ্জিনে ত্রুটির কারণে ট্রলার পানিতে নামানো যায়নি– এমন অজুহাতে প্রথম চার বছর ধরে ঋণ পরিশোধ থেকে বিরত ছিলেন। এক বছর করে দুই দফা ঋণের গ্রেস পিরিয়ড বাড়িয়ে নেন। এরপর ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৃতীয় দফা পুনঃতপশিলের জন্য অনুমোদন দেয় ব্যাংক। আরোপিত তথা আয় খাতে নেওয়া সুদের ১ কোটি ১৮ লাখ টাকার পুরোটাই মওকুফ করা হয়। ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি কোনো ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই সুদ মওকুফসহ ঋণটি পুনঃতপশিলের অনাপত্তি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা গেছে, আবারও এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ মাত্র ৮ শতাংশ সুদে তৃতীয় দফা ঋণটি ১২ বছরের জন্য পুনঃতপশিলের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ২০১৯ সালে আবার কিস্তি পরিশোধের সময় আসতেই এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড দেয় ব্যাংক। এরপর ২০২০ সালে শুরু হয় করোনা। ওই বছর কেউ এক টাকাও পরিশোধ না করলেও খেলাপি হয়নি। ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা বলে ২০২২ সালে আবার পুনঃতপশিল সুবিধা নেন হাছান মাহমুদ। এ দফায় সুদ মওকুফ দেওয়া হয় ৩২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

সর্বশেষ পুনঃতপশিল অনুযায়ী, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে প্রতি কিস্তিতে ৫৭ লাখ ৬৪ হাজার টাকা করে পরিশোধ করার কথা। সেই অনুযায়ী গত জুলাই পর্যন্ত ১৮টি কিস্তিতে মোট ১০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা পরিশোধ করার কথা। তবে তা আর করেননি। সুদে-আসলে তাঁর কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১৯ কোটি ৩ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে আয় খাতে নেওয়া হয়েছে– এ রকম ৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকার সুদ মওকুফের জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন তিনি। তবে ব্যাংক তাতে রাজি হয়নি।

এসব নিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে দেনদরবারের মধ্যে সরকার পতন হওয়ায় আত্মগোপনে চলে যান সাবেক এই মন্ত্রী। ফলে নতুন করে চাপ দেওয়া থেকে বেঁচে যাওয়ায় হাঁফ ছেড়েছে ব্যাংক। যদিও ব্যাংকের পাওনা আদায় নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এভাবে বারবার সুদ মওকুফ, ডাউন পেমেন্ট ছাড়া পুনঃতপশিল, ঋণ পরিশোধের সময় আসতেই গ্রেস পিরিয়ড বাড়ানোর নজির নেই।

রূপালী ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ :
২০১৭ সালে বিসমিল্লাহ মেরিনের ঋণ পুনঃতপশিলের বিশেষ সুবিধার বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ট্রলারটি ত্রুটিমুক্ত করতে কোনোভাবেই ৬ মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। তবে ঋণগ্রহীতা ও ডকইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করছে।’

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

এ বিষয়ে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় বলা হয়, মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্ট থেকে ২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ফিশিং ট্রলারের রেজিস্ট্রেশন ও কার্যক্রম সন্তোষজনক উল্লেখ করা হয়। অথচ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ওই বছরের ১৩ থেকে ১৫ ডিসেম্বরে ট্রলারের ট্রায়ালে সমস্যার কথা উল্লেখ করে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর আবেদন করে। প্রকৃতপক্ষে সমস্যা থাকলে ২৪ ডিসেম্বরের পরিদর্শন রিপোর্ট সন্তোষজনক থাকত না।

এ থেকে প্রতীয়মান হয়, গ্রাহক ট্রলারের সমস্যাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে ঋণ পরিশোধ করছে না। এর পরও তৎকালীন এমডি আতাউর রহমান প্রধানের জোর প্রচেষ্টায় বিশেষ সুবিধা পেয়ে যান তিনি। পরের বছর সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিযুক্ত হন আতাউর।

রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালের মার্চে আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘ট্রলার যে নেই তা নয়। ট্রলার আছে।’ চার বছর ধরে ইঞ্জিন ঠিক না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, নির্মাণ ত্রুটির কারণে ট্রলারটি সাগরে নামিয়েও ফল হয়নি। যে ধরনের ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন দেওয়ার কথা ছিল, হয়তো তা দেয়নি। যে কারণে মেরামতের জন্য নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে ফেরত দিয়েছে।

হাছান মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রী নুরান ফাতেমা পলাতক থাকায় এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। আর জাহাজ-ট্রলার নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠান এফএমসি ডকইয়ার্ডের কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, ট্রলারের নকশা ও আকারভেদে খরচ কেমন তা নির্ভর করে।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show