
সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নেে এমপি হতে যাচ্ছে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার কুখ্যাত রাজাকার আলী আহমদ টিকের ভাতিজি দিলোয়ারা ইউসুফ।
তার মনোনয়নের খবরে চট্টগ্রামজুড়ে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। দিলোয়ারা ইউসুফের সমর্থকরা এতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও অনেকেই হয়েছেন সমালোচনামুখর।
তারা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, কুখ্যাত রাজাকার আলী আহমদ ‘টিকে’র ভাতিজি দিলোয়ারা ইউসুফ পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন!
দেশ স্বাধীন হওয়ার তিন দিন পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারের কমান্ডার আলী আহমেদ ‘টিকে’কে রাস্তায় পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করে জঙ্গলে লাশ ফেলে দিলেও তার ভাই নুর আহমদের মেয়ে হতে চলেছেন ‘সংসদ সদস্য’।
একজন মুক্তিযোদ্ধা নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘হাটহাজারীর ফতেপুরের রাজাকার আলী আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেওয়া, নারীদের পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে পেয়েছিলেন ‘টিকে’ অর্থ্যাৎ ‘তকমায়ে খেদমত’ উপাধি। দিলোয়ারা ইউসুফের বাবা নুর আহমেদও ছিলেন রাজাকার বাহিনীর সক্রিয় সদস্য।’
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, আলী আহমদ এতোটাই দুর্ধর্ষ ছিলেন যে, স্বাধীনতার পরপরই ক্ষুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি পাথরের আঘাতে মাথা তেঁতলে দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছিল৷ ওই সময় দিলোয়ারা ইউসুফের বাবা নুর আহমেদকেও এলাকাছাড়া করেছিলেন ক্ষুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় হাটহাজারীর ফতেপুর গ্রামের আলী আহমেদ, অলি আহমেদ, নুর আহমেদসহ ছয় ভাইয়ের ঘরে স্থাপন করা হয়েছিল টর্চার সেল। মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ইসলামিয়া হাটস্থ রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ও শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন আলী আহমেদ টিকে। তাদের টর্চার সেল থেকে সাকা চৌধুরীর গুডস হিলে পাঠানো হতো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া পরিবারের নারীদের।’
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট কমান্ড প্রকাশিত দ্বিবার্ষিক প্রকাশনা ‘মুক্তি’র তথ্য অনুযায়ী, হাটহাজারীর বারেক সওদাগর বাড়ির মৌলানা আবদুস সবুরকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন আলী আহমদ টিকে। বারেক সওদাগরের মেজ ছেলে মৌলানা তৈয়বকে মেরে মুমূর্ষু অবস্থায় গুডস হিলে ফেলে আসা ছাড়াও স্কুলশিক্ষক সুকেন্দু বিকাশ দাশকে হাটহাজারীর অদুদিয়া মাদ্রাসায় নিয়ে হত্যা করে বালিচাপা দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধা আবুল মেম্বার ও হাফেজ কামালকে হাটহাজারীর মদনহাট এলাকায় নির্যাতনের মূল হোতাও ছিলেন তিনিই।
সেই নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা হাফেজ কামাল বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার মতো অনেকেই ওই পরিবারের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। নারীদের পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিতেন আলী আহমদ। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেবার কথা বলে টাকা আদায় করতেন।’
হাফেজ কামাল বলেন, দিলারা ইউসুফের বাবা নুর আহমদ কেরানী তাকে পাঞ্জাবিদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছেন। অস্ত্র থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। তিনি বলেন, ‘ওদের ঘর ছিল টর্চার সেল। পাঞ্জাবির ভয় দেখিয়ে অনেকের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন।’
বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দা রাজিয়া মোস্তফা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট কমান্ড প্রকাশিত ‘মুক্তি’ বইয়ে আলী আহমদ টিকে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আমি অবাক হয়েছি। ২০১৩ সালে উত্তর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের কমিটির অনুমোদন এক বছর দেরি করা হয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর পায়ে ধরে সেই কমিটির অনুমোদন নিয়েছিলাম। বিষয়টি আমার জানা ছিলো না; আজ এই রাজাকার পরিবারের নৃশংসতার তথ্য জেনে আমি অনুতপ্ত। কারণ উত্তর চট্টগ্রামের কুখ্যাত রাজাকার পরিবার থেকে এক নেত্রী সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়ন পেয়েছে। এটা মুক্তিযুদ্ধের অপমান—আমাদের জন্য লজ্জার। আমি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার বিচার চাই।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি নুরুল আফসার বলেন, ‘দিলওয়ারার ভাই নজরুল জাসদের নেতা ছিলেন। এছাড়া এই রাজাকার পরিবারের বাকি সদস্যদের কেউই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত নন।’
নেতৃস্থানীয় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আলী আহমদ টিকে উত্তর চট্টগ্রামের কুখ্যাত রাজাকার যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছেন। তার পরিবারের সদস্য সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়ন পেলেন—এর চেয়ে লজ্জার কিছু নেই। এর মানে আওয়ামী লীগসহ ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িত দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে না। রাজনৈতিক দলগুলো যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ব্যবসা করে, ক্ষমতায় থাকতে চায়—এমন অভিযোগের জ্বলজ্বল উদাহরণ কুখ্যাত রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত আলী আহমদ টিকের ভাতিজিকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়ন দেওয়া।’
এদিকে এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য দিলোয়ারা ইউসুফের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার প্রতিক্রিয়া জানা সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত, আইন প্রণয়নে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সালে সংবিধানে বিশেষ কোটা চালু করা হয়। তারপর থেকে প্রতিটি সংসদ নির্বাচনেই নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ থাকছে। একাদশ সংসদে চট্টগ্রাম থেকে দুজন নারী সংরক্ষিত আসনে এমপি ছিলেন। দিলোয়ারা ইউসুফসহ এবার সেই সংখ্যা বেড়ে তিনজন হয়েছে।