
সাদা কাগজে লেখা একটি চিরকুটের ওপর নির্ভর করে আগে প্রতিদিন শত কোটি টাকার লেনদেন হতো চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। বিশ্বাসের এই জায়গাটা দেশের অন্যসব বাজার থেকে আলাদা করে রেখেছিল খাতুনগঞ্জকে। সেই আস্থায় এখন চিড় ধরেছে।
গত দুই দশকে বিশ্বাসভঙ্গ করে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা মেরে দেওয়ায় এই বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে। সর্বশেষ ৭৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন খাতুনগঞ্জের সোনামিয়া মার্কেটের নুর ট্রেডিংয়ের মালিক নাজিম উদ্দিন। এসব ঘটনা খাতুনগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নামছে পাইকারি ব্যবসায় ধস।
ব্যবসায়ীরা জানান, চিরকুটের মাধ্যমে লেনদেনের কারণেই অসাধু ব্যবসায়ীরা অর্থ আত্মসাৎ করার সুযোগ পাচ্ছেন। যারা আগে বিশ্বাস ভঙ্গের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, তারা পার পেয়ে যাওয়ায় এখন অন্যরাও একই পন্থায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এ কারণে এখন খাতুনগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
খাতুনগঞ্জের তৈয়্যবিয়া ট্রেডার্সের মালিক সোলায়মান বাদশা বলেন, ‘লোভের কারণেই এই বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনাগুলো ঘটানোর সুযোগ পাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা যদি লোভ না করে তাহলে এটি কখনই ঘটবে না। আর একজন করে যদি পার পেয়ে যায়, তাহলে অন্যরাও এই কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হবেন। তাই কয়দিন পরপরই খাতুনগঞ্জে ব্যবসায়ীদের টাকা মেরে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই ধরনের প্রতারণা বন্ধ করার সুযোগ নেই। এটি বার বারই হবে। ব্যবসার নিয়ম হলো আপনি ডেলিভারি অর্ডারের মাধ্যমেই পণ্য কিনবেন। কিন্তু পণ্যের ডিও কেনার পর ওই প্রতিষ্ঠান পণ্য সরবরাহ না করে যদি টাকা মেরে দেন সেই ক্ষেত্রে আগে থেকে কিছু করার থাকে না।
ব্যবসায়ীরা জানান, নূর ট্রেডিং চলতি মাসের শুরু থেকে ৫ জুন পর্যন্ত চার-পাঁচ দিন ব্যবসায়ীদের কাছে এলাচের ডিও বিক্রি করলেও এর বিপরীতে ব্যবসায়ীদের পণ্য অথবা টাকা কোনোটি পরিশোধ করেননি। সর্বশেষ বুধবার (৫ জুন) ব্যবসায়ীর কাছে এলাচের ডিও বিক্রি করে টাকা নগদায়ন করে হঠাৎ মোবাইল বন্ধ করে দেন নূর ট্রেডিংয়ের নাজিম উদ্দিন। ওইদিন ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার এলাচের ডিও বিক্রি করলেও তার বিপরীতে ক্রেতাদের পণ্য কিংবা টাকা কোনোটাই দেননি এই ব্যবসায়ী।
পরে বিষয়টি নিয়ে বুধবার সন্ধ্যায় পাওনাদার ব্যবসায়ীরা নাজিমকে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে নিয়ে যান। ঘটনার সুরাহা না হওয়ায় ওই দিন রাতে তাকে সমিতির কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়। পরদিন তার ভগ্নিপতি এসে সমিতির নামে ১০ কোটি টাকার চেক দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এরপর থেকে নাজিম উদ্দিন এবং তার ভগ্নিপতির আর কোনো হদিস মিলছে না।
এর আগে বড় প্রতারণার ঘটনাটি ঘটে ২০১৩ সালের নভেম্বরে। ২৯ জন ব্যবসায়ীর ১৫০ কোটি টাকা মেরে বিদেশে পালিয়ে যান ইয়াছির গ্রুপের কর্ণধার মোজাহের আলম। তার আগে ২০১১ সালে ১৪৮ কোটি টাকা মেরে খাতুনগঞ্জ থেকে পালিয়ে যান চৌধুরী ব্রাদার্স ও চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা।
এভাবে টাকা আত্মসাতের ঘটনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে খাতুনগঞ্জের ব্যবসার পরিবেশকে। বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে খাতুনগঞ্জ ছেড়ে যাচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী। আস্থার সংকট তৈরি হওয়ায় এখানে কমেছে পণ্য বেচাকেনা।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, আসলে বিলপের মাধ্যমে যেই পণ্য বেচাকেনা হয়, এটি কোনো ব্যবসা না। বাইর থেকে আসা কিছু লোকজন এ ধরনের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। অতি লোভের আশায় পরে তারা লোকসানের মুখে পড়েন। দেড় মাস আগে নুর ট্রেডিংয়ের বিষয়টি জানার পর আমি খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনকে জানিয়েছি তারা প্রতিষ্ঠানটিকে নোটিস দিয়ে সতর্ক করেছিল। কিন্তু এরপরও ব্যবসায়ীদের রোধ করা যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের টাকা কীভাবে আদায় করা যায়, সেটি নিয়ে কাজ করার জন্য আমি ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনকে বলেছি। তারা কাজ করছে। তবে ব্যবসা করতে হলে আগে শিখতে হবে। না শিখে ব্যবসা করতে এলে এ ধরনের সমস্যায় পড়বে। আমরা ব্যবসায়ীদের এ ধরনের লেনদেন না করতে নিষেধ করি। ব্যবসায়ীরা নিজেরা যদি সতর্ক না হয়, তাহলে এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা আসলে রোধ করা সম্ভব না।
প্রসঙ্গত, খাতুনগঞ্জ হলো ভোগ্যপণ্যের অন্যতম পাইকারি বাজার। এই বাজার থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পণ্য নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। খাতুনগঞ্জে মূলত ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) বিলপের মাধ্যমে পণ্য বেচাকেনা হয়। আবার কিছু কিছু পণ্য ডিও বিলপে ছাড়াই শুধু একটি টোকেনের মাধ্যমে বিক্রি হয়। কিন্তু এই ডিও পরবর্তীতে পণ্য সরবরাহ ছাড়াই একাধিক হাত বদল হয়। এভাবে কয়েকবার হাতবদলের কারণে পণ্যের দামও বেড়ে যায় কয়েক দফা।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, প্রকৃত পণ্যের কোনো স্থানান্তর ছাড়াই এই ডিও হাতবদলের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা পণ্য বিশেষে লাখ থেকে কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করতে পারেন। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় এই ডিও ব্যবসা একসময় লাগাম ছাড়া হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে ডিও বিলপের বিপরীতে পণ্য সরবরাহ না করেই বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এই প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ এলাচ বিক্রি করে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সোনামিয়া মার্কেটের নুর ট্রেডিংয়ের মালিক নাজিম উদ্দিন।