শনিবার- ২২ মার্চ, ২০২৫

খুলছে যোগাযোগের আরেক স্বপ্নদুয়ার

ঢাকা থেকে কক্সবাজারে ট্রেন যাবে ১ ডিসেম্বর

print news

মাত্র ক‘দিন গেল দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বর্ণদুয়ার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উম্মুক্ত হল। এরই মধ্যে যোগাযোগের আরেক দুয়ার খোলার আওয়াজ কানে বাজতে শুরু করেছে চট্টগ্রামের মানুষের। সেটিও বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো আরও এক স্বপ্নের প্রকল্প। যার নাম দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্প।

আগামি ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে এ প্রকল্পের স্বপ্ন দুয়ার উদ্বোধন করবেন। তবে ১ ডিসেম্বর এ রেলপথে সরাসরি ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌছে যাবে যাত্রীবাহি ট্রেন। যার মাধ্যমে বিস্তার লাভ করবে পর্যটন খাত। সাথে মাতারবাড়ি গভীর সমূদ্রবন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে যোগ হবে নতুন মাত্রা। উম্মোচিত হবে যোগাযোগের নতুন খাত।

শুক্রবার (৩ নভেম্বর) এমন তথ্য জানিয়েছেন এ প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীণ। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যেমন রেলপথ রয়েছে। তেমনি চট্টগ্রাম থেকেও দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথ আছে। কিন্তু রেল নেটওয়ার্কের বাইরে থাকা পর্যটননগরী কক্সবাজারে রেল নেওয়ার জন্য দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে এই রেললাইন প্রকল্পের সার্বিক কাজ ৯২ ভাগ শেষ হয়েছে। এরমধ্যে ১০২ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে।

ফলে আগামি ৭ নভেম্বর রেল লাইনে ট্রেনের ট্রায়াল রান করা হবে। ১১ নভেম্বর এই প্রকল্প উদ্বোধন করা হবে। যদিও এই রেল লাইন প্রকল্প উদ্বোধনের সর্বশেষ তারিখ ছিল ১২ নভেম্বর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্প উদ্বোধন করতে চট্টগ্রাম আসবেন।

তবে প্রকল্প উদ্বোধনের সাথে সাথে এই রেলপথে ট্রেন চলাচল সম্ভব হবে না। কারণ আনুষাঙ্গিক কিছু কাজ এখনো বাকি রয়েছে। এরমধ্যে চলমান কালুরঘাট সেতুর সংস্কার কাজও রয়েছে। এই সেতু সংস্কারে কিছু ত্রুটি ধরা পড়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে নয়টি রেলস্টেশনের মধ্যে তিনটির কাজ বাকি রয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে এসব কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এরপর ১ ডিসেম্বর এই রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরুর পরিকল্পনা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম থেকে প্রথমে দুই জোড়া এবং ঢাকা থেকে এক জোড়া ট্রেন এই রেলপথে আসা-যাওয়া করবে। চট্টগ্রাম থেকে তিন ঘণ্টা ২০ মিনিট এবং ঢাকা থেকে আট ঘণ্টা ১০ মিনিটে ট্রেন কক্সবাজার পৌঁছাবে। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ও চট্টগ্রাম স্টেশনে যাত্রাবিরতি করবে। আর চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলো মাঝপথে কয়েকটি স্টেশনে দাঁড়াবে।

সময়সূুুচি অনুযায়ী, ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী ট্রেনটি রাত সাড়ে ১০টায় ঢাকা ছেড়ে পরদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে কক্সবাজার পৌঁছাবে। দুপুর ১টায় পুনরায় ঢাকার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার ছেড়ে রাত ৯টা ৫ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছাবে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারগামী ট্রেনগুলোর মধ্যে একটি সকাল ৭টায় চট্টগ্রাম ছেড়ে সকাল ১০টা ২০ মিনিটে কক্সবাজারে পৌঁছাবে। অন্যটি বিকাল ৩টা ১০ মিনিটে চট্টগ্রাম ছেড়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কক্সবাজার পৌঁছাবে।

ঢাকা থেকে কক্সবাজার ৫৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ রুটে নন-এসি আসনের জন্য ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে ৫১৫ টাকা, এসি আসন ৯৮৪ টাকা, এসি কেবিন ১১৮৫ টাকা এবং এসি স্লিপিং বার্থ ১৭৭১ টাকা। এ ট্রেনে ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার যাওয়া যাবে। এই আন্তঃনগর ট্রেনে ৭৩৭ থেকে ৭৯৭টি আসন থাকবে। ২টি খাবার কোচ, পাওয়ার কার ১টি, এসি কেবিন ৩টি, এসি চেয়ার কোচ ৫টি, শোভন চেয়ার কোচ ৬টি ও ১ম শ্রেণির ১টি কোচ থাকবে।

মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে ঢাকা থেকে চলাচলকারী ট্রেনটির। এরমধ্যে ট্রেনটির ছয়টি নাম প্রস্তাব করেছে রেলওয়ে। প্রস্তাবিত নামগুলো হলো, প্রবাল এক্সপ্রেস, হিমছড়ি এক্সপ্রেস, কক্সবাজার এক্সপ্রেস, ইনানী এক্সপ্রেস, লাবণী এক্সপ্রেস ও সেন্টমার্টিন এক্সপ্রেস। ছয়টি নাম থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি নাম চূড়ান্ত করবেন। সেই নামে ট্রেনটি চলবে।

মো. সুবক্তগীণ আরও বলেন, এটি সরকারের একটি মেগা প্রকল্প। মানুষের অনেকদিনের স্বপ্ন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে পর্যটননগরী কক্সবাজারের সরাসরি রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে করে পর্যটকরা সহজেই সমুদ্রসৈকতে যেতে পারবেন। এছাড়া ওই অঞ্চলের মাতারবাড়ি গভীর সমূদ্রবন্দর থেকে এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য, সামুদ্রিক মাছ ও বনজ স¤পদ দ্রুত, সহজে ও সুলভে দেশের অন্যান্য এলাকায় পরিবহন করা সম্ভব হবে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, এর আগে গত ১৫ অক্টোবর এই রেল লাইনের ট্রায়াল রান ও ২৮ অক্টোবর উদ্বোধনের কথা ছিল। কিন্তু আগস্ট মাসে বন্যায় সাতকানিয়া অংশে রেললাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া কালুরঘাট সেতুর সংস্কার কাজেও দেরি হয়। পরে ১ নভেম্বর ট্রায়াল রান ও ১২ নভেম্বর উদ্বেধনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তাও আবার পিছিয়ে ৭ নভেম্বর ট্রায়াল রান ও ১১ নভেম্বর উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণা করা হয়।

কালুরঘাট সেতু সংস্কারে ত্রুটি :
ঢাকা থেকে কক্সবাজার রেল নিতে গত দুই মাস ধরে সংস্কার করা হচ্ছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদির উপর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত প্রায় শত বছরের পূরণো ঝুঁকিপূর্ণ কালুরঘাট সেতু। যেখানে পূর্বনির্ধারিত সময়ে সংস্কারকাজ পরিদর্শনে যায় বুয়েটের পরামর্শক দল।

পরিদর্শনে তারা সেতুর উপর দিয়ে পরীক্ষামূলক রেলগাড়ি চালানোর কথা থাকলেও তা তারা করেননি। সংস্কারকাজে বেশ কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করে পরিদর্শক দল। তাই পরীক্ষামূলক রেল চালানোর সিদ্ধান্ত পিছিয়ে শনিবার (৪ নভেম্বর) নির্ধারণ করা হয়। এদিন সবকিছু ঠিক থাকলে এই রেললাইনে ট্রেন চলাচল সম্ভব হবে।

এমন তথ্য জানিয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞা। তিনি বলেন, কালুরঘাট সেতুর সংস্কারকাজে সামান্য কিছু ত্রুটি দেখিয়েছে বুয়েট টিম। আমরা অবশ্য একটি গ্যাংট্রিন চালিয়ে দেখেছি। কোনো সমস্যা হয়নি। এরপরও উনারা যে সমস্যাগুলো দেখিয়েছে, সেগুলো আমরা ঠিক শুক্রবারের মধ্যে ঠিক করে নিবো। আশা করি সব ঠিক থাকলে উনারা আগামী শনিবার সেতুর উপর দিয়ে ট্রায়াল রান করে দেখবেন।

সূত্রমতে, এ রেলপথের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। প্রকল্পের আওতায় রেললাইন ছাড়াও ৯টি স্টেশন করা হয়েছে। ৬ তলাবিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন ঝিনুক আকৃতির কক্সবাজার আইকনিক স্টেশনে সব ধরনের অত্যাধুনিক সুবিধা রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। শুরুতে এ প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

তবে অর্থসংস্থান না হওয়ায় এ সময় কাজ আটকে যায়। পরে এডিবির সঙ্গে চুক্তির পর সরকার ও এডিবি মিলে এই প্রকল্পে জন্য ১৮ হাজার কোটি ৩৪ টাকা অর্থের জোগান দেয়। ২০১৮ সালে ডুয়েলগেজ সিঙ্গেল ট্র্যাকের এ রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে।

ঈশান/সুম/খম

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page