বৃহস্পতিবার- ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫

গ্যাসসংকট সমাধানে ভূলপথে সরকার

গ্যাসসংকট সমাধানে ভূলপথে সরকার
print news

তীব্র গ্যাসসংকট, পাশাপাশি চলছে বিদ্যুৎবিভ্রাটও। কিন্তু এ সমস্যা সমাধানে সরকার কম চেষ্টা করছেনা। তবে সংকট সমাধানে সরকার যে পথে এগোচ্ছে সেটাকে ভুলপথ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিমাত্রায় জ্বালানি আমদানি নির্ভরতার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সামনে এই সংকট আরও বাড়বে। ডলারসংকটকালে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে আরও নাকাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

জানা যায়, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদার তুলনায় ঘাটতি ৪০ শতাংশ। দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ২৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট পাওয়া যাচ্ছে আমদানিকরা এলএনজি থেকে।

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম বলেন, আমদানি করার কারণে নিজেদের গ্যাস উত্তোলনে অবহেলা করা হচ্ছে। শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকার পরও গ্যাসের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

আরেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলছেন, জরুরি ভিত্তিতে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে জোর দিতে হবে। অনেক আগেই এমনটা করা উচিত ছিল। তাহলে আজ এত খারাপ অবস্থা হতো না। আশির দশকে অনেক গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেলেও চাহিদা কম ছিল। এরপর আর গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

গ্যাস অনুসন্ধানে অবহেলা

যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে ও অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় বাংলাদেশ তার মজুত খুঁজে বের করতে এবং ট্যাপ করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের তুলনায়ও বাংলাদেশ অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে কম। ত্রিপুরার মতো ছোট্ট একটি রাজ্য যেখানে ১৫০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে, সেখানে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত প্রায় ১০০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে কম অনুসন্ধানকারী দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মাত্র এক তৃতীয়াংশ গ্যাস অনুসন্ধান করা হয়েছে। গ্যাস আবিষ্কারের সাফল্য যদিও এখানে বৈশ্বিক গড় থেকে অনেক বেশি, তারপরও এখানে অনুসন্ধান কমই হয়েছে।

এছাড়া গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমা রয়েছে যেটা ২৬টি ব্লকে বিভক্ত। এরমধ্যে ২৩টি এখনো উন্মুক্ত। মাত্র তিনটি ব্লকে ভারত ও সিঙ্গাপুরের তেল কোম্পানি অনুসন্ধান চালাচ্ছে।

অথচ ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধ মিটে যাওয়ার পর দুটি দেশই তাদের সমুদ্রসীমায় দ্রুত অনুসন্ধান চালিয়ে গ্যাস আবিষ্কার করেছে। মিয়ানমার ও ভারত তাদের সমুদ্রসীমায় আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন ইতিমধ্যে শুরু করেছে।

এ অবস্থায় সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার বলেছেন, ভোলায় তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেলেও সেই গ্যাস এখনো জাতীয় গ্রিডে আনা যাচ্ছে না। বাকি যেসব ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে, চাহিদার তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয়। এখন আমরা আরও নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দিচ্ছি।

বাড়ছে আমদানি নির্ভরতা

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি খাতের পরিকল্পনাতেই গলদ রয়েছে। পরিকল্পনায় উৎপাদনের চেয়ে আমদানিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ ভুল।

বিদ্যুৎ বিভাগের মহাপরিকল্পনা ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান-২০১৬’ দেখলেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়। সেখানে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যে জ্বালানি লাগবে তার ৪০ ভাগই আমদানি করতে হবে। এটা ২০৪০ সালের মধ্যে হবে ৯০ ভাগ।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

আমদানি করা এলএনজি সরবরাহের জন্য পাইপলাইন নির্মাণের উদ্যোগ
আমদানি নির্ভরতার দিকেই এগোচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে সরকার বিপুল ব্যয়ে অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে। স্থানীয় উৎপাদন কমায় এলএনজি সরবরাহ বাড়াতে ১৪০ কোটি ডলার ব্যয়ে পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। প্রস্তাবিত ২৯৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মহেশখালী/মাতারবাড়ী-বাখরাবাদ পাইপলাইনটি ২০২৯ সাল নাগাদ নির্মাণ করা হবে।

গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) ইতোমধ্যে নীতিগত অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন লাভের পর বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছে ঋণ প্রস্তাব পাঠানো হবে।

জানা যায়, বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে ২০৩৩ সালের মধ্যে দেশের বর্তমান গ্যাস রিজার্ভ সম্পূর্ণ নি:শেষ হয়ে যাবে। তখন গ্যাসের দৈনিক চাহিদা হবে ৬ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। এমন প্রেক্ষাপটে নির্মাণ করা হচ্ছে এই পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা।

শীতকালেও সর্বগ্রাসী সংকট

ঢাকা ও চট্টগ্রামের বহু এলাকায় প্রায়ই গ্যাস থাকে না বললেই চলে। অথচ তাদের বিল দিয়ে যেতে হচ্ছে। অনেক এলাকার গৃহিণীরা সারা রাত জেগে রান্না করেন। কারণ দিনের বেলা গ্যাস পাওয়া যায় না।

আরও ভয়াবহ অবস্থা শিল্প-কারখানায়। ঢাকার আশ-পাশের শ্যামপুর, কাঁচপুর, ভুলতা ও রূপগঞ্জের একাধিক শিল্প-কারখানায় গ্যাসের কারণে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানা গেছে। অনেক শিল্পকারখানা উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। একই পরিস্থিতি চট্টগ্রামেও।

সংকট শুধু শিল্প বা বাসাবাড়িতেই নয়। পরিবেহনে ব্যবহৃত সিএনজিরও সংকট চলছে। দিনে-রাতে মিলিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের অধিকাংশ সিএনজি স্টেশন গভীর রাতে তিন থেকে চার ঘণ্টা গ্যাস পায়। গ্যাস পেলেও প্রেসার থাকে না। এতে জনসাধারণের শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে গ্যাস বিতরণ সংস্থাগুলো।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

এ অবস্থায় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলছেন, মার্চে সংকট কমে আসবে। এছাড়া ২০২৬ সালের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করবে।

এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার উপ-মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তারিকুল ইসলাম খান বলেন, শীতকালে চাহিদার তুলনায় গ্যাস উত্তোলন কম হয়। এ সময়ে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় পাইপলাইনে তরল পদার্থ জমে গ্যাস প্রবাহের চাপ কমে যায়। তাছাড়া পাইপলাইনগুলোও অনেক পুরোনো। এটাও গ্যাস কম থাকার কারণ। পাইপগুলো পরিবর্তন করা গেলে গ্যাসের লাইনে কম্প্রেশার দিয়ে গ্যাস উত্তোলন করতে অনেকটা সুবিধা হবে।

গরমে অবস্থা আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা

বাংলাদেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রই বেশি। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গড়ে দৈনিক ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু গরমকালে এই চাহিদা বেড়ে যায় অনেক বেশি।

পূর্ববর্তী বছরগুলোতে দেখা গেছে, গরমকালে ১৬ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। আগামী গরমে এই চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। বিপুল এই গ্যাসের অর্ধেকেরও বেশি আসে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে।

পেট্রোবাংলার হিসাব বলছে, এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের চাহিদাই হবে দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে সাড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় ৪০ শতাংশের মতো।

ঈশান/মখ/সুপ

আরও পড়ুন

No more posts to show