মঙ্গলবার- ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ঘুর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে অচল চট্টগ্রাম

ঘুর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে অচল চট্টগ্রাম
print news

# সাগরে জাহাজ ও বঙ্গবন্ধু টানেলে গাড়ি চলাচল বন্ধ
# শাহ আমানতে উঠানামা করছে না বিমানও

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে অচল হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বন্দরে উড়ছে ৯ নং মহাবিপদ সংকেত। এছাড়া বন্দরের নিজস্ব অ্যালার্ট-৬ জারি করা হয়েছে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের সকল ধরণের অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। খালি করা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি।

বন্ধ রয়েছে সাগরে জাহাজ চলাচল। বড় জাহাজগুলোকে গভীর সমুদ্রে এবং ছোট জাহাজগুলোকে কর্ণফুলী নদির উজানে কালুরঘাটের দিকে নিরাপদে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি চলাচলও বন্ধ রাখা হয়েছে কর্ণফুলী নদিও তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল।

ঘৃুর্ণিঝড় মোকাবেলায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে। এসব সংস্থার লোকজন সমুদ্র উপকুলীয় এলাকা থেকে মানুষদের সরিয়ে নিতে কাজ করছেন। করছেন মাইকিং। পাহাড় থেকেও সরে যেতে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে।

রবিবার বিকেলে সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান জানান, বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় চট্টগ্রামে এক হাজার ৯২৫টি আশ্রয়কেন্দ প্রস্তুত করা হয়েছ্রে। এর মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৭৮৫টি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও এক হাজার ১৪০টি বিদ্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া নয়টি মুজিব কেল্লা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক জানান. ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের উদ্যোগে মোট ২৯৫টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে ২০০টি, প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫টি, ৯টি আরবান ডিসপেনসারিতে ৯টি এবং জেনারেল হাসপাতালে ৫টিসহ মোট ২৯৫টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য প্রায় তিন লাখ ট্যাবলেট ও চার লাখ খাবার স্যালাইন মজুত রয়েছে।

তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় চট্টগ্রামে প্রস্তুত রয়েছে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৮ হাজার ৮৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক। আছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক। এ ছাড়াও বিএনসিসি ও স্কাউটের স্বেচ্ছাসেবকগণকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে চট্টগ্রামে ব্যাপক বর্ষণ ও পূর্ণিমার কারণে তীব্র জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা থাকায় উপকূলবর্তী এলাকারসমূহ ও পাহাড়ি এলাকা থেকে লোকজনকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট ইউএনও এবং এসিল্যান্ডদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। নির্দেশনা অনুসারে উপকুলীয় ব-দ্বীপ সন্দ্বীপ উপজেলার ৯ হাজারেরও বেশি মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সমন্বয়ের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। যার নম্বর ০২৩৩৩৩৫৭৫৪৫। এছাড়া ৯টি স্টেশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে ২৭০ জনকে প্রস্তুত রেখেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। পাশাপাশি নগরের আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে চালু করেছে বিশেষ কন্ট্রোল রুম। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও সব ধরনের প্রস্তুতি স¤পন্ন হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছেড়ে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। এছাড়াও খোলা হয়েছে জরুরি কন্ট্রোল রুম।

চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়, ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে প্রায় ৯০ শতাংশ ফসল কাটা হয়েছে। এ সময় জেলা প্রশাসক মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রাণীর সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সকলকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রোববার দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সকল ধরণের উড়োজাহাজ উঠানামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিমানবন্দরের পরিচালক উইং কামান্ডার তছলিম উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৯ নং মহাবিপদ সংকেত জারীর পর চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অ্যালার্ট-৬ জারি করা হয়েছে। এর ফলে বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য খালাস কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। জাহাজ থেকে পণ্য, কনটেইনার লোড-আনলোড বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন টার্মিনাল, ইয়ার্ড ও শেডে পণ্য ও কনটেইনার ডেলিভারি কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। সাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। বড় জাহাজগুলোকে গভীর সাগরে ও ছোট জাহাজগুলোকে কর্ণফুলী নদির উজানে কালুরঘাটের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিউজিসিসহ জেটির হ্যান্ডলিং ইক্যুইপমেন্ট নিরাপদে রাখতে প্যাকিং করে রাখা হচ্ছে। বন্দরের মেরিন, নিরাপত্তা, ট্রাফিক ও সচিব বিভাগের পৃথক কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, বন্দরের অভ্যন্তরে গত রাত ৯টা পর্যন্ত স্বাভাবিক কার্যক্রম চলেছে। রাত ৯ টায় ৬ নম্বর বিপদ সংকেত ঘোষণার পর চট্টগ্রাম বন্দরে এলার্ট-৩ ঘোষণা করা হয়। এতে পরবর্তী জোয়ারে জেটির সব জাহাজ বের করে দেওয়া হবে। বন্দরের কী গ্যান্ট্রি ক্রেন, পন্টুনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতির নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ছোটখাট ইকুইপমেন্টগুলোকে এক স্থানে জড়ো করে নিরাপদে রাখা হচ্ছে। তবে রবিবার সকালে ৯ নং মহাবিপদ সংকেত জারির পর বন্দরের নিজস্ব অ্যালার্ট-৬ জারি করা হয়েছে। এরপর বন্দরের সকল ধরণের অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ ঘোষনা করা হয়।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে রোববার (২৬ মে) সন্ধ্যা থেকে সোমবার (২৭) সকাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু টানেল বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান। রোববার (২৬ মে) সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির সভা শেষে তিনি এ তথ্য জানান।

এ ছাড়া দুর্যোগ মোকাবিলা এবং দুর্গত মানুষের পাশে থাকার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ সব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী। প্রতিন্ত্রী বলেন, ৮ লাখের বেশি মানুষ ইতোমধ্যে আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছেন। বাকিদের আসার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে আপাতত স্কুল খোলা থাকবে তবে ক্লাস বন্ধ থাকবে।

এদিকে উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে আজ সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে মোংলার নিকট দিয়ে সাগর আইল্যান্ড (পশ্চিমবঙ্গ)- খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম করতে পারে। এ অবস্থায় পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

রবিবার (২৬ মে) ১২ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল রবিবার (২৬ মে) দুপুর ১২ টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ২২০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র অতিক্রমের পর এর নিম্নভাগ অতিক্রম অব্যাহত থাকবে।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটার এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ০৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার নদী বন্দরসমূহকে ৪ নম্বর নৌ-মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ু তাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে দমকা ও ঝড়ো হাওয়া সহ ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। এর প্রভাবে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে বলা হয়েছে।

উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show
error: Content is protected !!