বৃহস্পতিবার- ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫

ঘুষ দিয়ে নিয়োগ পেলেও বেতন পাচ্ছে না রেলের আউটসোর্সিং কর্মীরা

ঘুষ দিয়ে নিয়োগ পেলেও বেতন পাচ্ছেন না রেলের আউটসোর্সিং কর্মীরা
print news

নিয়োগ পেতে দিতে হয়েছে মোটা অঙ্কের ঘুষ। বছরের কাছাকাছি চাকরি হলেও বেতন মেলেনি এক টাকাও। ফলে খেয়ে না খেয়ে উপোষ জীবন-যাপন করছেন ঠিকাদারের অধীনে নিয়োগ পাওয়া রেলের আউটসোর্সিং শ্রমিকরা।

তাদের অভিযোগ, আউটসোর্সিংয়ের নামে পকেট ভরানোর ফাঁদ নিয়ে বসেছে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। যারা ইতোমধ্যে নিয়োগের নামে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রত্যেক কর্মীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন ৪-৫ লাখ টাকা করে। যদিও ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের কেউ বিষয়টি স্বীকার করেনি।

এর মধ্যে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমার্শিয়াল দপ্তরের অধীনে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগের কাজ পাওয়া এন কে এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী নুরুল কবির বাপ্পি বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০ জনকে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগের কাজ পায়। এদের অনেকের নিয়োগ হয়েছে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে, আবার কারও নিয়োগ হয়েছে জুন-জুলাইয়ে। কিন্তু তাদের কেউ এখনও এক টাকাও বেতন পায়নি। ফলে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। এ সময় নিয়োগে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম) মাহবুবুর রহমান এর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে অতিরিক্ত চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার জোবেদা আক্তার (সংস্থাপন বিভাগে সদ্য বদলি প্রাপ্ত) বলেন, ঠিকাদাররা টাকা হাতিয়েছেন সেটা শুনেছি। তবে এসবের সাথে আমি নাই। আমি নিয়োগ কমিটিতেও নেই। আমার সিসিএম আছে। আপনি ওনার সাথে কথা বলুন। কিন্তু অফিসে গিয়েও সেই সিসিএমকে পাওয়া যায়নি।

একইভাবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ৬০০ জনকে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগের কাজ পায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান শাহ আমানত এন্টারপ্রাইজ। যাদের একেক জনের চাকরি ৪-১০ মাস পূর্ণ হলেও এখনো বেতন পায়নি কেউ। এ বিষয়ে জানতে শাহ আমানত এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শহীদুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। ফোনের পর তার মুঠোফোনে হিন্দি ভাষায় সংযোগ দেয়া সম্ভব নয় বলে দুঃখ প্রকাশ করা হয়।

এদিকে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরেও আউটসোর্সিং নিয়োগের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তৎকালীন চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কুদরত-ই-খুদা ও ডেপুটি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা উক্ত আউটসোর্সিং নিয়োগের অর্থ বানিজ্যের মূলহোতা। তবে অর্থ লেনদেন হয়েছে এই দপ্তরের বড় বাবু আসরাফ ও সদর দপ্তরের ডেপুটি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ফজলে রবের হাত দিয়ে।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার টেন্ডার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে আউটসোর্সিং নিয়োগ দিলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর পছন্দের লোকজনকেই অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেন। নতুন পুরাতন মিলে প্রায় ৪৭৩ জনকে এক লাখ থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে উক্ত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আউট সোর্সিং নিয়োগের নিয়ম ভঙ্গ করে অনেক পুরাতন কর্মীদের বাদ দিয়ে নতুন লোকজন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আউটসোর্সিং এর নিয়োগ টেন্ডার পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও।

মো. মোরশেদ নামে এক ঠিকাদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগে প্রায় অসহায় তারা। অফিসারদের কমিশনসহ এককালীন (সিকিউরিটি ছাড়া) অর্থ দিতে হয়েছে তাদের। এ নিয়ে ভয়ে মুখও খুলতে পারছেন না তারা। মুখ খুললেই অফিসাররা ব্লাক লিস্টে দিয়ে দিবে তাদের লাইসেন্স। এতে বন্ধ হয়ে যেতে পারে কাজ পাওয়া।

তিনি জানান, পাকশী ডিবিশনের ডেপুটি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারি মমতাজ উদ্দিন তাঁর ডিবিশনে অনেকজনকে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি দুটি প্রতিষ্ঠানকে ৪টি লটে কাজ দেন। পান্নার প্রতিষ্ঠান জামান এন্টারপ্রাইজ কাজ পায় তিনটি। জাকি এন্টারপ্রাইজের খসরু পায় ১টি। উক্ত ৪ লটে পুরাতন আউটসোর্সিং এর তালিকায় নতুনদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই নিয়োগের জন্য অফিসারদের দিতে হয়েছে অর্থ। একইভাবে লালমনিরহাট ডিবিশনেও হয় অর্থ বানিজ্য।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডেপুটি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পাকশী) মমতাজ উদ্দিন বলেন, আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদার তাদের বিধিমতে দিয়েছেন। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। তবে আমরা শুনেছি ঠিকাদাররা এই নিয়োগের ক্ষেত্রে ৪-৫ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন।

চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কুদরত ই খুদা বলেন, নিয়ম মাফিক নিয়োগ হয়েছে। এখানে আমাদের অনিয়মের কোনো সুযোগ নাই। অনিয়ম করলে সেটা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান করেছে। আপনি অফিসে আসেন বিস্তারিত বুঝিয়ে বলা যাবে।

রেলের একটি নির্ভরযোগ্য সুত্র নিশ্চিত করে বলেন, টেন্ডারের মাধ্যমে কাজটি পেয়েও মাত্র ২ জন লোক নিয়োগ দিতে পেরেছেন একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বাকী সব লোক নিয়োগ দেন চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও তাঁর অফিসের লোকজন। প্রায় ৪৭৩ জন লোক নিয়োগে প্রায় ৩ কোটি টাকা বানিজ্য হয়েছে বলেও সুত্রটি নিশ্চিত করেছেন।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

এছাড়া আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্যের কথা শুনেছেন বলে স্বীকার করেছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সিসিএস দপ্তরের প্রধান সিসিএস থেকে রেলপথ পরিদর্শক পদে সদ্য বদলি হওয়া মো. ফরিদ উদ্দিন। চট্টগ্রাম বিভাগীয় জিএম সাইফুল ইসলামও।

মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, আমার এখানে আউসোসিংয়ে মাত্র ২ জন ড্রাইভার রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন না পাওয়ায় তারা বেতন পাচ্ছেন না। এছাড়া নিয়োগে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে এটা শুনেছি। তবে এর দায় রেলওয়ের নয়, ঠিকাদারের।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ঠিকাদাররা টাকা নিয়েছে শুনেছি। এতে রেলওয়ে কর্মকর্তাদের কোন হাত নেই। আপনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কথা বলুন। আর আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়াদের বেতন অনুমোদনের বিষয়টি বর্তমানে মন্ত্রণালয়ে আছে। মন্ত্রণালয় থেকে আসলে তাদের বেতন প্রদান শুরু হয়ে যাবে।

পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মামুদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আমি অবগত নই। বেতনের মোট অর্থের ৫% পাবেন ঠিকাদার। বাকী টাকা কর্মীরা পাবেন। নিয়োগ হয়েছে ঠিকাদারের তালিকা অনুযায়ী। যা করার তারাই করেছে।

আউটসোর্সিং কর্মীরা জানান, রেলে আগে নিয়োগ পাওয়া ছয় হাজারের মতো অস্থায়ী শ্রমিক (টিএলআর) আছেন। এছাড়া চলতি বছরের শুরু থেকে ড্রাইভার, পয়েন্টেসম্যান, খালাসি, পরিছন্নতাকর্মী, ক্লিনার, ওয়েম্যান, গ্রেড কিপার, টিকেট কালেক্টর, সহকারী স্টেশন মাস্টার, গার্ড, ট্রেন এক্সিমিনার, লোকো, ক্যারেজ, ডিএস(ডব্লিউ) পদে পর্যায়ক্রমে ১৯ ক্যাটাগরিতে আউটসোর্সিংয়ে ১ হাজার ৪২৪ জন কর্মী নিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়।

নিয়োগের কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শাহ আমানত এন্টারপ্রাইজ, এন কে এন্টারপ্রাইজ, মর্ডাণ এন্টারপ্রাইজ, জামান এন্টারপ্রাইজ, জাকি এন্টারপ্রাইজ, জান্নাত এন্টারপ্রাইজ, এইচ এন্ড এইচ এন্টারপ্রাইজ। যারা চলতি বছরের শুরু থেকে জুলাই পর্যন্ত এই নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করে। নিয়োগে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪-৫ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ কয়েক মাস থেকে প্রায় বছরের কাছাকাছি চাকরি করেও বেতন মিলেনি কারও।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

চট্টগ্রামে কর্মরত অস্থায়ী শ্রমিক নাছির উদ্দিন নসু জানান, ৮ মাস ধরে কাজ করছি। মাসে সাড়ে ১৬ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু এক টাকাও পায়নি। স্ত্রী, তিন সন্তান নিয়ে খেয়ে-না খেয়ে পড়ে আছি। আমাদের কী হবে বুঝতে পারছি না। তবুও চাকরি একদিন স্থায়ী হবে এ আশায় কাজ করছি।

কয়েকজন আউটসোর্সিং কর্মী জানান, রেলওয়ের এই প্রকল্পের নামে আমাদের জীবন শেষ। মাসের পর মাস চাকরি করেও বেতন পাচ্ছি না। ঠিকাদার ও রেল কর্মকর্তারা মিলে যা ছিল তাও হাতিয়ে নিয়েছে। একেকজনে জমি-জমা বিক্রি করে ৪-৫ লাখ করে টাকা এনে দিয়েছি। সব মিলিয়ে এখন অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটছে আমাদের।

শ্রমিকরা বলেন, রেল বেতনের টাকা কর্মীকে সরাসরি না দিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেবে। তারা দেবে কর্মীকে। কর্মী সরবরাহের জন্য ঠিকাদারকে কমিশন বাবদ টাকা দেবে রেল। এখানে রয়েছে বড় ফ্যঁদ। ঠিকাদার আর রেল কর্মকর্তারা মিলে ভুয়া শ্রমিক দেখিয়ে বিল তুলবে। এতে তাদের পকেট ভরবে।

রেলওয়ের তথ্যমতে, আউটসোর্সিংয়ে কর্মীদের বেতন ১৬ হাজার ২৬০ থেকে ১৭ হাজার ২৬০ টাকা। ১ হাজার ৪২৪ জন কর্মীর জন্য মাসে ঠিকাদারকে দিতে হবে দুই কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা। বছরে দিতে হবে ২৮ কোটি ৪১ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। এর সঙ্গে যোগ হবে ঠিকাদারকে দেওয়া কমিশন। ফলে অস্থায়ী শ্রমিকদের জন্য রেলের যে খরচ হয়, আউটসোর্সিংয়ে হবে এর চেয়েও বেশি। এভাবে রেলের টাকায় ঠিকাদারদের পকেট ভরবে বলে মনে করছেন অনেকে।

এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) সরদার সাহদাত আলীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এডিজি পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ১ জুলাই থেকে শুরু অর্থবছরে অস্থায়ী শ্রমিকদের মজুরির জন্য বরাদ্দ পায়নি রেলওয়ে। গত বছরের ২ অক্টোবর অর্থ বিভাগ অস্থায়ী শ্রমিকদের মজুরি আউটসোর্সিং খাত থেকে দিতে শর্ত দিয়েছে। ফলে বিষয়টি নিয়ে একরকম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এতে প্রকল্পের ভবিষ্যত দেখার অপেক্ষায় আছি।

ঈশান/খম/বেবি

আরও পড়ুন

No more posts to show