সোমবার- ১৯ মে, ২০২৫

ঘুষ বাণিজ্যে ডুবে আছে চট্টগ্রাম বিআরটিএ

ধরা পড়ে দালাল-কর্মচারি, আড়ালে ডিডি-এডি

ঘুষ বাণিজ্যে ডুবে আছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) চট্টগ্রাম কার্যালয়। যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন নিবন্ধন থেকে শুরু করে রুট পারমিট, ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, নম্বর প্লেট, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ কোনো কাজই হয় না ঘুষ ছাড়া। আর এই ঘুষ লেনদেনের মাধ্যম হচ্ছেন দালাল ও কর্মচারিরা। মুল হোতা হচ্ছেন ডিডি-এডিরা। যারা বরাবরের মতো আড়ালেই থেকে যাচ্ছেন।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের বালুচরা এলাকায় অবিস্থত বিআরটিএ কার্যালয়ে দুদকের অভিযানে ঘুষ বাণিজ্যের সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে এমন তিন কর্মচারি ও চার দালাল। এদের মধ্যে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসে তিন কর্মচারিকে বাদ দিলেও চার দালালকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে দুদক।

দুদকের অভিযানে ধরা তিন কর্মচারির মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বিআরটিএ কার্যালয়ের নিন্মমান সহকারি এনামুল হক, উচ্চমান সহকারি ইমরান টিপু ও অপর একজনের নাম জানা যায়নি। দালালের মধ্যে শুধুমাত্র একজনের নাম জানা গেছে। তার নাম হচ্ছেন মো. মহিউদ্দিন।

আটক দুই কর্মচারি ও এক দালালকে শনাক্ত করেন বিআরটিএ চট্টগ্রাম মেট্টো-২ সার্কেলের উপ-পরিচালক (ইঞ্জি:) সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরী। অপর এক কর্মচারি ও তিন দালালকে শনাক্ত করতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর এই উপ-পরিচালক বলেন, আমি নতুন এসেছি। তাই অনেককে চিনি না।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কার্যালয়ে ঘুষ বাণিজ্যে জড়িত কর্মচারি ও দালালরা অনেক আগে থেকেই কর্মরত আছেন। কিন্তু আমি নতুন আসায় কে কর্মচারি আর কে দালাল তেমন পরিচিতি নেওয়া সম্ভব হয়নি। এদের ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়ে কে বা কারা অনেক আগেই দুদকে অভিযোগ করেছে। সে সময় এই কার্যালয়ে মেট্টো-১ সার্কেলের দপ্তর ছিল। মেট্টো-১ সার্কেল গত এক-দেড়মাস ধরে নগরীর হালিশহর থেকে পরিচালিত হচ্ছে। এ বিষয়ে তারাই ভাল জানেন।

এদিকে অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া দুদকের সহকারি পরিচালক এনামুল হক বলেন, বিআরটিএ চট্টগ্রাম অফিসে বিভিন্ন সেবা দেওয়ায় গ্রাহক হয়রানি ও দালালদের দৌরাত্ন্যের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুরে অভিযান চালানো হয়।

অভিযানের শুরুতে এনফোর্সমেন্ট টিম ছদ্মবেশে গ্রাহক হিসেবে সেবা নিতে গেলে দালালদের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এসময় চারজন দালাল ও বিআরটিএর তিনজন কর্মচারিকে হাতেনাতে আটক করে দুদক টিম। তাদের সঙ্গে সরাসরি বিভিন্ন সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে অস্বাভাবিক আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যায়।

এনফোর্সমেন্ট টিম আটক চার দালালকে বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (ইঞ্জি.) সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরীর কাছে উপস্থিত করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে তাদের পুলিশে সোপর্দ করা হয়। তাছাড়া বিআরটিএ অফিসের কর্মচারিদের স¤পৃক্ততার বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারিদের বিরুদ্ধে আইনগত বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে দুদক টিমকে জানানো হয়।

এর আগে গত ২০২১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বিআরটিএ চট্টগ্রাম কার্যালয়ে সাঁড়াশি অভিযান চালায় র‌্যাব-৭। সেখান থেকে ৩০ দালালকে আটক করে ২০ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করা হয়। এ সময়ও অন্তরালে থেকে যায় ঘুষ বাণিজ্যের মূল হোতা কার্যালয়ের তৎকালীন বিভাগীয় পরিচালক (ডিডি) মো. শহীদুল্লাহ ও উপ-পরিচালক (এডি) মো. তৌহিদুল ইসলাম। ফলে দালালদের দৌরাত্ন্য ও ঘুষ বাণিজ্য কমেনি একটুও। বরং হালিশহরে মেট্টো-১ সার্কেলেও জমজমাট ঘুষ বাণিজ্যে চালাচ্ছেন উপ-পরিচালক (এডি) মো. তৌহিদুল ইসলাম। আর দুদকের অভিযান সেখানেই জরুরী বলে মন্তব্য করেছেন ভুক্তভোগীরা।

ঘুষ আদায় হচ্ছে যেভাবে :
চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার বিভিন্ন সড়কে প্রায় ২ লাখেরও বেশি গাড়ি চলাচল করে। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ গাড়ির ফিটনেস নেই। নেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও। অথচ বছরের পর বছর রাস্তায় চলছে এসব গাড়ি। এতে নিত্য দুর্ঘটনায় ঘটছে প্রাণহানিও।

পরিবহন সংগঠনের নেতারা বলছেন, ফিটনেস না থাকলে নম্বরপ্লেট না দেওয়ার কথা। কিন্তু নির্ধারিত ফির সঙ্গে ঘুষ দিলেই মিলছে নম্বরপ্লেট। নতুন গাড়ি রেজিস্ট্রেশনে নম্বরপ্লেটের জন্য আদায় করা হচ্ছে ৪ হাজার ৬২৮ টাকা। আগে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে এমন গাড়ির নম্বরপ্লেটের জন্য আদায় করা হচ্ছে ৩ হাজার ৬৫২ টাকা।

একইভাবে প্রতিটি বাসের রুট পারমিট ও ফিটনেসের জন্য ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার, হিউম্যান হলার ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার, ট্রাক ২ হাজার থেকে ৩ হাজার, ড্রাম ট্রাক ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার, মিনিট্রাক ২ হাজার থেকে ৩ হাজার, টে¤পু ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার, অটোরিকশা ৪০০ ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য অতিরিক্ত ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা বাড়তি দিতে হয়। ফলে ফিটনেসবিহীন গাড়ির চালকরাও পাচ্ছেন লাইসেন্স। আর এ সবকিছুর সুবিধা নিচ্ছে পুলিশ।

থ্রি হুইলার নিবন্ধনে জালিয়াতি :
চট্টগ্রাম মহানগরীতে অটোরিকশার আদলে ম্যাক্সিমা, এইচ পাওয়ার, মাহিন্দ্রা, টমটমসহ ৪ আসনের প্রায় ৩ হাজার থ্রি হুইলার নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এগুলো পাঁচ বছর ধরে চলাচল করছে নগরীতে। এ ছাড়া ১০ আসনের অটোটে¤পুুও নিবন্ধন দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম অটোরিকশা-অটোটেম্পু শ্রমিক লীগের (রেজিঃ নং-চট্ট ১৪৬৯) সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খোকন রিট আবেদন করলে হাইকোর্টের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের বেঞ্চ তা চলাচল বন্ধ ও জব্দের আদেশ দেন। কিন্তু বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশের সহযোগিতায় এসব গাড়ি চলছে নগরীতে।

অভিযোগ আছে, অটোরিকশা ও অটোটে¤পুর আদলে এসব গাড়ির নিবন্ধন দেন বিআরটিএ চট্টগ্রাম অফিসের সাবেক পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ। এ কাজে তিনি প্রতিটি গাড়ি থেকে ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ আদায় করেন। এছাড়া সিএনজি অটোরিকশা নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে।

দালালচক্রের দৌরাত্ন্য :
পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শুরুতে একজন চালক শিক্ষানবিশ লাইসেন্স পান। কিছু দিন গাড়ি চালানোর পর লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল মূল লাইসেন্স পান। কিন্তু সংঘবদ্ধ দালালদের মাধ্যমে বিআরটিএ থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে কোনো রকম বেগ পেতে হয় না।

অভিযোগ রয়েছে, বিআরটিএ চট্টগ্রামের দুই সার্কেলেই সংঘবদ্ধচক্র ঘুষের বিনিময়ে এসব কাজ করে। গত বৃহস্পতিবার অবৈধ লেনদেনের সময় তিন কর্মচারি ও চার দালালকে হাতে নাতে আটক করে দুদক। ২০২১ সালে ব্যাবের অভিযানেও এই চক্রের ৩০ জন ধরা পড়ে। কিন্তু অধরা থেকে যান মূল হোতা সাবেক ডিডি মো. শহীদুল্লাহ। বর্তমান ডিডি মো. শফিকুজ্জামান ভুঁইয়া ও দুই মেট্টো সার্কেলের এডি সাহেবরা। আর এসব কাজ করে তারা এখন বিপুল অর্থবিত্তের মালিক।

রাজস্ব ক্ষতি যেভাবে :
ভুক্তভোগীদের মতে, চট্টগ্রাম মেট্রো ও জেলা অফিস মিলে ৪ হাজার ১৫৩টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশনে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেট্রো-১ সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) তৌহিদুল ইসলাম গাড়ির সিসি কম দেখানোর কৌশল নেন। গাড়ি ও কাগজপত্র পরীক্ষা না করে রেজিস্ট্রেশন অনুমোদনে তাকে সহায়তা করেন অফিস সহকারীরা। এসব অনিয়মের মাধ্যমে তারা সরকারের ৩৯ লাখ ৭৬ হাজার ৪৪২ টাকা রাজস্ব ক্ষতি করেছেন।

ঘুষ বাণিজ্যে ও দালালদের দৌরাত্ন্য সম্পর্কে জানতে রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বালুচরা বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়েও বিভাগীয় পরিচালক (ডিডি) মো. শফিকুজ্জামান ভুঁইয়ার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি তখন কার্যালয়ে ছিলেন না। এ সময় তিনি সিলেটে অবস্থান করার কথা জানান কার্যালয়ে কর্মরত লোকজন। এরপর তার ব্যবহৃত অফিসিয়াল মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। ফলে তার বক্তব্য উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একইভাবে ফোন রিসিভি করেননি হালিশহরে অবস্থিত চট্টগ্রাম মেট্টো-১ সার্কেলের এডি মো. তৌহিদুল ইসলামও।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page