মঙ্গলবার- ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

চট্টগ্রামের ১০ আসনে সংঘাতের আশঙ্কা, নিরাপত্তা জোরদার

চট্টগ্রামের ১০ আসনে সংঘাতের আশঙ্কা, নিরাপত্তা জোরদার
print news

“চট্টগ্রাম জেলায় সাড়ে ৪ হাজার পুলিশ সদস্য নির্বাচনের দায়িত্বে রয়েছে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তার মধ্যে প্রথমে কেন্দ্রে থাকবে পুলিশ এবং আনসার সদস্যদের নিরাপত্তা বলয়, এরপর থাকবে মোবাইল টিমের সদস্যরা। আগে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে মোবাইল টিমের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করত। এবার আমরা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়নে দুটি করে মোবাইল টিম দিয়েছি। যাতে কেউ কোন ধরনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও করতে না পারে। -চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ”

চট্টগ্রামের ১৬ সংসদীয় আসনের মধ্যে ১০ আসনে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন ভোটাররা। এসব আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের বিপরীতে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের। এর মধ্যে একজন বর্তমান সংসদ-সদস্যও রয়েছেন।

এসব আসনে ইতোমধ্যে দফায়-দফায় নির্বাচনী সংঘাত হামলা ও গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। নির্বাচনপূর্ব সহিংসতার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরপর থেকে ভোটারদের মাঝে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে।

তবে সংঘাত এড়াতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাচনের দায়িত্বশীল জেলা-বিভাগীয় রিটার্নিং অফিসাররা। এরমধ্যে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট গ্রহণের জন্য আমাদের (প্রশাসনের) পক্ষ থেকে সর্বাত্নক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, আগামীকাল ৭ জানুয়ারি রবিবার সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হবে। ভোটাররা উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন। এই ব্যাপারে আমরা কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। বিশেষ করে সন্দ্বীপ, পটিয়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া ও ফটিকছড়ি আসনকে আমরা বিশেষ নজরদারিতে রেখেছি। আমরা ভোটারদের আশ্বস্ত করে বলতে চাই-নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে আসুন, উৎসবমুখর পরিবেশ ভোট দিন।

চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ বলেন, চট্টগ্রাম জেলায় সাড়ে ৪ হাজার পুলিশ সদস্য নির্বাচনের দায়িত্বে রয়েছে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তার মধ্যে প্রথমে কেন্দ্রে থাকবে পুলিশ এবং আনসার সদস্যদের নিরাপত্তা বলয়, এরপর থাকবে মোবাইল টিমের সদস্যরা। আগে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে মোবাইল টিমের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করত। এবার আমরা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়নে দুটি করে মোবাইল টিম দিয়েছি। যাতে কেউ কোন ধরনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও করতে না পারে।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে গুদাম থেকে রেলের মূল্যবান সরঞ্জাম উধাও!

তৃতীয় ধাপে থাকবে স্ট্রাইকিং ফোর্স (পুলিশ এবং আনসার ব্যাটালিয়নের ফোর্স থাকবে), এরপর থাকবে ডিএসবির সদস্যদের সমন্বয়ে গোয়েন্দা নজরদারি। এরপর থাকবে চেক পেয়েন্ট, অবৈধ কোনো অস্ত্রশস্ত্র কেউ বহন করছে কিনা, কেউ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করার চেষ্টা করছে কিনা সেটা প্রতিটি পয়েন্টে মনিটরিং করা হবে। এছাড়াও থাকবে ট্রাফিক ম্যানেজম্যান্ট।

পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ আরও বলেন, আমরা শুরু থেকে যেটা বলেছি, এখনো সেটা বলছি, নির্বাচন হবে শতভাগ সুষ্ঠু। কেউ এদিক-ওদিক করার সুযোগ তো দূরে থাক, চিন্তাও করতে পারবে না। কোনো কেন্দ্রে যদি কেউ বিন্দুমাত্র প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করলে সাথে সাথে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। কাউকে কোন ধরনের ছাড় দেয়া হবে না। এই ক্ষেত্রে কোনো প্রিসাইডিং অফিসারের যদি কোনো ধরনের দায়িত্ব অবহেলা থাকে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশ এবং আনসার সদস্যদের দায়িত্ব পালনে কোনো ধরনের অবহেলা দেখা গেলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিশেষ করে পটিয়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া, মীরসরাই, জোরারগঞ্জ, ফটিকছড়ি-ভূজপুরকে আমরা বিশেষ নজরদারিতে রেখেছি।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ১৬টি আসনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম জেলা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে সাড়ে ৪ হাজার করে ৯ হাজার পুলিশের অফিসার ও সদস্য নির্বাচনী মাঠে মোতায়েন করা হয়েছে। নির্বাচনী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

চট্টগ্রামের ১০ আসনে সংঘাতের আশঙ্কা, নিরাপত্তা জোরদার

চট্টগ্রামের ১৬ আসনে ৯৬ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়াও র‌্যাবের ৩২টি টহল টিম নির্বাচনী এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও চট্টগ্রামের ১৬ আসনে ৮২ জন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ও ৩২ জন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে মাঠে কাজ করছেন।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে গুদাম থেকে রেলের মূল্যবান সরঞ্জাম উধাও!

তিনি আরও বলেন, নগরীর ৬টি সংসদীয় আসনের ৬৬০টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪৪৬টি কেন্দ্রকে গুরুত্বপূর্ণ এবং ২১৪টি কেন্দ্রকে সাধারণ কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একইভাবে চট্টগ্রাম জেলার ১০টি সংসদীয় আসনের ১৩৬৩টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ১০১৩টি ভোট কেন্দ্রকে গুরুত্বপূর্ণ এবং ৩৫০টি ভোটকেন্দ্রকে সাধারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

আর এসব গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে চারজন ও কম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে বা সাধারণ ভোটকেন্দ্রে তিনজন সশস্ত্র পুলিশ এবং ১৫ আনসার সদস্য থাকবেন। পাশাপাশি মোবাইল টিম, থানা এবং কন্ট্রোল রুমে স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে। সোয়াট, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াডের কে-নাইন ইউনিটকেও স্ট্রাইকিং হিসাবে রাখা হচ্ছে। এতে ভোট কেন্দ্রের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকবে।

কিন্তু ভোটারদের ভাষ্য, বিএনপি-জামায়াত ভোটের মাঠে না থাকলেও কিছু কিছু আসনে নৌকার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় এসব আসনে ভোটের দিন সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। আসনগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই), চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি), চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ), চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও), চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-হালিশহর), চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা), চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া), চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ), চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া আংশিক) ও চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী)।

ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই), চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ), চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া), চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ), চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া আংশিক) ও চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে নির্বাচনি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চট্টগ্রাম-১০ (খুলশী, পাহাড়তলী, হালিশহর) ও চট্টগ্রাম-১১ (পতেঙ্গা-বন্দর) আসনের নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর রেষারেষি ক্রমশ বাড়ছে। তাতে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচনের দিন সংঘাতের আশঙ্কা করছেন ভোটাররা।

ভোটারদের মতে, চট্টগ্রামে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ আসন হিসেবে মনে করা হচ্ছে চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া)। এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী (নৌকা)। নৌকা প্রতীক না পেয়ে এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করছেন টানা তিনবারের সংসদ-সদস্য ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরী। তার প্রতীক ঈগল। নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা একাধিকবার স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজনের ওপর হামলা করেছে। অনেকে আহত হয়েছে। এ দুই প্রার্থী ঘিরে ইতোমধ্যে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতারা। নেতাকর্মীরা প্রচারণাও চালিয়েছেন বিভক্ত হয়ে। ইতোপূর্বে প্রচারণা ঘিরে সংঘাতও হয়েছে একাধিকবার। এ কারণে পটিয়া আসনে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন ভোটাররা।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে গুদাম থেকে রেলের মূল্যবান সরঞ্জাম উধাও!

একইভাবে চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া আংশিক) আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী এম এ মোতালেবের সমর্থক এক চেয়ারম্যানের বাড়িতে নৌকা প্রতীকের ¯ে¬াগান দিয়ে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে গত ১৮ ডিসেম্বর। গভীর রাতে সাতকানিয়া উপজেলার পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিদোয়ানুল ইসলাম সুমনের বাড়ি ইছানগরে এ হামলার ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তরা স্বতন্ত্র প্রার্থী এমএ মোতালেবের প্রচার কাজে নিয়োজিত একটি মাইক্রো, পুলিশ পরিবহনে নিয়োজিত সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও নির্বাচনি অফিস ভাঙচুর করে।

আবার গত ২১ ডিসেম্বর চরতি এলাকায় বর্তমান এমপি প্রফেসর ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর স্ত্রী ও চরতি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রুহুল্লার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। আসনটিতে ১৫৭টি ভোটকেন্দ্র। এরমধ্যে সাতকানিয়ার ৯০টির মধ্যে ৫৫টি এবং লোহাগাড়া ৬৭টি কেন্দ্রের সবগুলোকেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করে শান্তিপূর্ণ ভোটের প্রস্তুতি নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এছাড়া চট্টগ্রাম-৩ আসন (সন্দ্বীপ) আসনে নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের একাধিকবার নির্বাচনি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। মামলা হয়েছে চারটি। চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) ও চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব নির্বাচনি সংঘাতে একাধিক মামলাও হয়েছে। এসব কারণে ভোটররা আশঙ্কা করছেন নির্বাচনের দিন সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে উভয়পক্ষই।

তবে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আরিফ হোসেন বলছেন, সংঘাতের আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে সন্দ্বীপে আমরা ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করেছি। এছাড়া ৭ প্লাটুন কোস্টগার্ড এবং র‌্যাবের দুটি টিম মোতায়েন করা হয়েছে। পটিয়ায় ৮ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বাঁশখালীতে ৮ প্লাটুন, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া ৮ প্লাটুন, ফটিকছড়িতে ৮ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামের ১৬ আসনে ৮২ জন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ও ৩২ জন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচনী এলাকাগুলোতে কাজ করছেন।

ঈশান/মখ/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show