সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও অপরাধজনিত কারণের চেয়ে মৃত্যু বেশি সড়ক দূর্ঘটনায়। চট্টগ্রমে মোট মৃত্যুর ৫৬ শতাংশই সড়ক দূর্ঘটনাজনিত। এর মধ্যে মোট মৃত্যুর ৩০ শতাংশ মোটরসাইকেল ও থ্রি হুইলারের চালক-যাত্রীরা।
বন্দরনগরীর হওয়ায় চট্টগ্রামের সড়কগুলোতে প্রচুরসংখ্যক ভারী ট্রাক-লরী চলাচল করে। ফলে সড়কের অধিকাংশ পথচারী এসব যানবাহন মৃত্যুর জন্য দায়ী। এছাড়া মৃত্যুর অধিকাংশই মোটরসাইকেল আরোহী।
শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) এ তথ্য জানান সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্রের কথা তুলে ধরতে গিয়ে সিএমপি কমিশনার বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মানুষ বিভিন্ন অপরাধজনিত কারণে মারা যায়, তার চেয়ে বেশি মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়।
তিনি বলেন, গত জুলাই মাসে সারা দেশে খুন হয়েছে ২৯৬ জন। একই মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার হার অর্ধেকে কমিয়ে আনার ব্যাপারে সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন।
একইভাবে চট্টগ্রাম মহানগরীতেও প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের হার ৩৮ শতাংশ বেড়ে ২০২০ সালে ২ দশমিক ১ থেকে ২ দশমিক ৯ জনে পৌঁছেছে। নিরাপদে হাঁটার মতো সড়ক পরিকাঠামোর অপ্রতুলতার কারণে শহরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে। মোট মৃত্যুর ৫৬ শতাংশই পথচারী। এর বাইরে দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩০ শতাংশ মোটরসাইকেল ও থ্রি হুইলারের চালক-যাত্রীরা।
বন্দর নগরীর হওয়ায় চট্টগ্রামের সড়কগুলোতে প্রচুরসংখ্যক ভারী ট্রাক চলাচল করে এবং এসব যানবাহন অধিকাংশ পথচারী ও মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যুর জন্য দায়ী। গত তিন বছরে চট্টগ্রাম নগরীতে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ২৬৩ জন নিহত হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রকাশিত সড়ক নিরাপত্তা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটি (বিআইজিআরএস) প্রোগ্রামের আওতায় প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সংস্থা ভাইটাল স্ট্রাটেটিজ।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে গত তিন বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীতে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে বায়েজিদ থানা এলাকায়। এরপরই রয়েছে বাকলিয়া থানা এলাকা। দুর্ঘটনায় সব বয়সী পথচারীর মৃত্যুর হার কাছাকাছি হলেও শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ঝুঁকি বেশি।
নগরীর সড়ক নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য প্রতিবেদনে শহরের ১০টি করে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ স্থান এবং সড়ক চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অনুযায়ী সবচেয়ে বিপজ্জনক সড়ক হচ্ছে বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়ক যেখানে গত তিন বছরে প্রতি কিলোমিটারে প্রায় পাঁচটি করে মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
অন্যদিকে নগরীর সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান হচ্ছে টাইগার পাস মোড় এবং আউটার রিং রোডের খেজুরতলা। গত তিন বছরে সেখানে ২৫০ মিটারের মধ্যে পাঁচ জন মারা গেছে। প্রতিবেদনে নগরীর সড়কগুলো নিরাপদ করতে বেপরোয়া গাড়ি চালনা বন্ধ করা, পথচারীদের নিরাপদে হাঁটার জন্য ফুটপাত প্রশস্ত করা, উঁচু ক্রসওয়াক নির্মাণ, নিরবচ্ছিন্ন ফুটপাত নিশ্চিত করা, মোটরসাইকেলের পরিবর্তে বাইসাইকেল ব্যবহার উৎসাহিত করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া বেপরোয়া গাড়িচালনা নিয়ন্ত্রণ করতে শহরে বাস রুট রেশনালাইজেশনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
এদিকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ১২টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এর অন্যতম কিশোর-যুবকদের বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালানো, অতি উচ্চগতির মোটরসাইকেলের সহজলভ্যতা, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা না থাকা, পারিবারিকভাবে সন্তানদের বেপরোয়া আচরণ প্রশ্রয় দেওয়া, রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর সংস্কৃতি। পাশাপাশি ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতাকেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে উল্লেখ করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, দেশের সর্বত্র কিশোর-যুবকদের হাতে বেশি গতির মোটরসাইকেলের ছড়াছড়ি। এগুলো ক্রয় ও ব্যবহারে নিয়মকানুন মানার বালাই নেই; নেই মনিটরিং ব্যবস্থা।
তিনি আরও বলেন, মানসম্মত গণপরিবহনের অভাব ও যানজটের কারণে মোটরসাইকেলের ব্যবহার অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য গণপরিবহনব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য করে মোটরসাইকেলের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে হবে।
সাইদুর রহমান বলেন, গণপরিবহনব্যবস্থা উন্নত না করে মোটরসাইকেল উৎপাদন উৎসাহিত করা সরকারের একটি আত্নঘাতী ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। সরকারের উচিত, এখনই মোটরসাইকেল উৎপাদন, ক্রয় ও ব্যবহারে লাগাম টেনে একটি টেকসই গণপরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে ১৩টি সুপারিশ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এগুলোর অন্যতম কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া; মাত্রাতিরিক্ত গতিস¤পন্ন মোটরসাইকেল উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা; মহাসড়কে মোটরসাইকেলের আলাদা লেন তৈরি, গণপরিবহন উন্নত ও সহজলভ্য করে মোটরসাইকেল ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা।
এছাড়া দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়ানো, গণপরিবহনের চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কের সার্ভিস রোড নির্মাণ করা, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছে সংগঠনটি।