মঙ্গলবার- ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

চট্টগ্রামে কোটা আন্দোলনে অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই পুলিশের!

২৮ মামলায় আসামি ৩৬ হাজার, গ্রেফতার ৮০৩

চট্টগ্রামে কোটা আন্দোলনে অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই পুলিশের
print news

কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষের ঘটনায় চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত ২৮ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে ১৬৯ জনের নামসহ ৩৬ হাজারের বেশি আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় শুক্রবার (২৬ জুলাই) পর্যন্ত ৮০৩ জন আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এদিকে সংঘর্ষে গুলিতে নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ মামলা হয়েছে পুলিশের উপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধার অভিযোগে। একইভাবে সংঘর্ষে অংশ নেওয়া অস্ত্রধারী কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।

সংঘর্ষে অস্ত্রধারী ও পুলিশের গুলিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া পাঁচ শিক্ষার্থী ও এক শ্রমিক হত্যার ঘটনা ঘটে। আহত হয় আরও দুই শতাধিক মানুষ। যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল গুলিবিদ্ধ। এমন তথ্য উঠে এসেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তছলিম উদ্দিনের মুখে।

তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে কয়েকদিনের সংঘর্ষের ঘটনায় আহত মোট ২০৮ জন চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আহত ১৬ জন এখনও চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এর মধ্যে একজন আইসিইউতে। তাঁর অবস্থা শঙ্কামুক্ত নয়।

সূত্র জানায়, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই বেলা ৩টার দিকে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে জড়ো হন কোটা আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হন। এ সময় সংঘর্ষের মধ্যে শিক্ষার্থীদের মিছিল লক্ষ্য করে চার ব্যক্তিকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। তাতে তিনজন নিহত হন। আহত হন অন্তত ৩০ জন।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

আর সংঘর্ষে মারা যাওয়া তিনজনের একজন হলেন, ওয়াসিম আকরাম। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মেহেরনামা এলাকার সবুর আলমের ছেলে তিনি। আরেকজন চট্টগ্রাম মহানগরের ওমরগণি এমইএস কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ফয়সাল আহমেদ শান্ত। অপরজনের নাম মো. ফারুক, তিনি পথচারী ছিলেন। তাঁর বাড়ি কুমিল্লায়। তিনি ফার্নিচারের দোকানে চাকরি করতেন।

আর গুলি করা সেই চার ব্যক্তির মধ্যে একজন মো. ফিরোজ। তিনি মহানগর যুবলীগের কর্মী। অন্যজন মো. দেলোয়ার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সংগঠক। ফিরোজ রিভলবার নিয়ে এবং দেলোয়ার শটগান নিয়ে গুলি করেন। বাকি দুজন এইচ এম মিঠু ও মো. জাফর। তাঁরা দু‘জনও যুবলীগের কর্মী বলে জানা গেছে। তাঁদের রিভলবার নিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুবলীগের ফিরোজ একসময় শিবিরের ক্যাডার ছিলেন। মুরাদপুরের ত্রাস ছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে। সর্বশেষ চট্টগ্রামের আলোচিত স্কুলছাত্রী তাসফিয়া আমিন হত্যা মামলার অন্যতম আসামি তিনি।

এ বিষয়ে মো. ফিরোজের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি মিছিলে গুলি করার কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, রিভলবার হাতে ওই ব্যক্তি আমি না। তবে যুবলীগের বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন, রিভলবার হাতে ওই ব্যক্তি ফিরোজই।

এছাড়া ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বহদ্দারহাট মোড়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন চার অস্ত্রধারী। হামলাকারীরা সরকারদলীয় স্লোগান দিয়েছেন। বেশ কয়েকটি গ্রুপ ছাত্রদের ওপর হামলা করেছেন। কালো টি শার্ট ও নীল গেঞ্জি পরা দু‘জনকে একটি শটগান দিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে। বহদ্দারহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের সামনে একটি গ্রুপ থেকে ওই দুজন গুলি ছোড়েন। আরও দুজন রিভলবার দিয়ে গুলি করেছেন।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

এর মধ্যে হেলমেট ও সাদা গেঞ্জি পরা একজন রিভলবার দিয়ে গুলি ছুড়েছেন। তিনি চান্দগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মহিউদ্দিন ফরহাদ। তাঁর সঙ্গে আরও একজন রিয়াল মাদ্রিদের গেঞ্জি-ক্যাপ ও মুখোশ পরে রিভলবার দিয়ে গুলি ছুড়েছেন। তিনি মো. জালাল। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অন্যজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।

আর এই সংঘর্ষে মারা যান তিনজন। তাঁরা হলেন- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। তিনি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার রতন চন্দ্র তরুয়ার একমাত্র ছেলে। আরেকজন তানভীর আহমেদ (১৯)। তিনি মহেশখালীর নোয়াপাড়া এলাকার বাদশা মিয়ার ছেলে। তিনি আশেকানিয়া ডিগ্রি কলেজের মানবিক বিভাগের ছাত্র ছিলেন। অপরজন সন্দ্বীপের হারামিয়া ইউনিয়নের বিধবা রহিমা বেগমের ছোট ছেলে সাইমন হোসেন (১৯)। তিনি নগরীর বহদ্দারহাটে একটি মুদিদোকানে কাজ করতেন।

চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সাধারণ স¤পাদক দিদারুল আলম অস্ত্রধারীদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এখন পর্যন্ত এই আট অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। গ্রেপ্তার বা অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, সহিংসতার অভিযোগে চট্টগ্রাম মহানগরীতে এখন পর্যন্ত ১৭ মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচলাইশ থানায় ছয়টি, কোতোয়ালীতে চারটি, বাকলিয়ায় একটি, চান্দগাঁওয়ে চারটি, খুলশী থানায় একটি এবং হালিশহর থানায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। নগরীর এসব মামলার ৯টিতেই পুলিশ বাদি হয়েছে। অপর আটটি মামলার একটি করেছে বহাদ্দারহাটের পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং অন্যগুলোতে বাদি হয়েছেন বিভিন্ন ব্যক্তি। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ৪৬৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

এদিকে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আবু তৈয়ব মো. আরিফ বলেন, কোটা আন্দোলন নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলার ১০টি থানায় ১১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ৩৩৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, মামলায় বেশির ভাগই অজ্ঞাতপরিচয় আসামি হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে যাঁরা গ্রেফতার হচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, জামায়াত, শিবিরসহ বাম সংগঠনের নেতা-কর্মী। অবশ্য পুলিশ দাবি করছে, ঘটনার সময় সিসিটিভি ফুটেজে পাওয়াসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বে থাকা মো. ইদ্রিস আলী বলেন, তিনি বলেন, আন্দোলনটি ছিল ছাত্রদের। ওই আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপি কোনোভাবেই যুক্ত ছিল না। অথচ ১৬ জুলাই থেকে বিএনপি, যুবদল, কৃষক দলসহ তাঁদের ৩১০ জন নেতা-কর্মীকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরপরও হয়রানির উদ্দেশ্যে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। থানায় থানায় আমাদের নিরীহ নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিযোগিতা চলছে।

ঈশান/খম./সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show
error: Content is protected !!