
চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে ঘাতকব্যাধীর চেয়েও বাড়ছে আত্নহত্যার ঘটনা। চলতি সপ্তাহের তিনদিনে তিনটি আত্নহত্যার ঘটনা ঘটেছে শুধু চট্টগ্রাম নগরেই। এতে শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় চট্টগ্রামে আত্নহত্যার বিষয়টি চলে আসে সবার সামনে। এসব ঘটনা যেমন ভাবাচ্ছে পুলিশ প্রশাসনকে তেমনি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন সমাজবিজ্ঞানীরাও।
সিএমপির তথ্যমতে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত শুধুমাত্র চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২৫৯ জন আত্নহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। নগরীর বাইরে জেলায়ও আত্নহত্যার আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। সে হিসেবে গত বছরের চেয়ে চট্টগ্রামে আত্নহত্যার ঘটনা অনেকগুণ বৃদ্ধির পথে।
সূত্র জানায়, গত ২০২২ সালে চট্টগ্রামে মোট আত্নহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে ৫২৬ জন। ২০২১ সালে ৩৯৭টি আত্নহত্যার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে নগরীর শ্রমিক প্রবণ বন্দর ও ইপিজেড এলাকায় আত্নহত্যার হার বেশি। তবে ভিআইপি এলাকা খুলশীতে আত্নত্যার ঘটনা খুবই কম।
সাম্প্রতিক আত্নহত্যার ঘটনাগুলো :
চট্টগ্রাম মহানগরীর সদরঘাট থানাধীন পোস্ট অফিস গলি এলাকায় গলায় ওড়না পেঁচিয়ে গত ২৭ আগস্ট শনিবার রিমঝিম দাশগুপ্ত (২০) নামের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থী আত্নহত্যা করেছে। পরীক্ষার প্রবেশপত্র হারিয়ে ফেলায় সে আত্নহত্যা করে। বৃহ¯পতিবার কলেজ থেকে আসার সময় এইচএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র হারিয়ে ফেলে ওই শিক্ষার্থী।
এরপর গত ২৮ আগস্ট সোমবার নগরীর ইপিজেড এলাকায় স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে তিন বছরের শিশুসহ এক গৃহবধূ আত্নহত্যা করে। ইপিজেড থানা সংলগ্ন ব্যাংক কলোনির শাহ আলম কন্ট্রাক্টরের ভবনে এ ঘটনা ঘটে। এর পর ৩০ আগস্ট মঙ্গলবার স্বামীর সাথে ঝগড়া করে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লালানগর ইউনিয়নে নুর আয়েশা বেগম (৪০) নামে এক গৃহবধূ আত্নহত্যা করেন।
আত্নহত্যায় ঝুঁকছে বেশি তরুণ-তরুণীরা
আত্নহত্যা নিয়ে সম্প্রতি চট্টগ্রামের এক এনজিওর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরে ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সের তরুণরাই আত্নহত্যার দিকে ঝুঁকছে বেশি। পিছিয়ে নেই তরুণীরাও। চলতি বছরে ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সী ৬৫ তরুণ, ৫৮ তরুণী আত্নহননের পথ বেছে নিয়েছেন। এছাড়া ১০ থেকে ১৫ বছরের আট কিশোর ও ১৪ কিশোরী, ২৬ থেকে ৩৫ বছরের ২৬ পুরুষ, ২৮ নারী, ৩৬ বছরের ঊর্ধ্বে ৪৩ পুরুষ ও ১৭ নারী নিজের প্রাণ নিজেই হরণ করেন।
আত্নহত্যার কারণ:
সর্ম্প্রতি অনেক কিশোর-কিশোরী আত্নহত্যাকে ট্রেন্ড হিসেবে অনুসরণ করছে। মোবাইল ফোন অথবা শখের মোটর বাইক কিংবা অন্য কোনো শখের বস্তু কিনে না দেওয়ায়ও অনেক কিশোর বয়সীর আত্নহত্যার খোঁজ পাওয়া যায়। এমনকি যেকোনো পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল করতে না পেরেও আত্নহত্যার ঘটনা ঘটছে। মোটামুটি বয়স্ক মানুষও আত্নহত্যা করতে পিছপা হয় না। এক্ষেত্রে পারিবারিক কলহ, স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া, আর্থিক অনটন, জীবিকার সংকট ও অনিশ্চয়তা, ঋণ পরিশোধ, প্রেমঘটিত বিবাদ, মা-বাবার সঙ্গে অভিমান, হতাশা, যৌতুক ও মানসিক বিষাদ অন্যতম।
গবেষণার তথ্যমতে, চট্টগ্রামে শুধুমাত্র পারিবারিক সমস্যায় আত্নহত্যার হার ৪১ দশমিক ২ শতাংশ। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, বৈবাহিক সমস্যায় ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, ভালোবাসায় প্রতারিত হয়ে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, বিবাহবহির্ভূত গর্ভধারণ ও যৌন স¤পর্ক নিয়ে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, স্বামীর নির্যাতনে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অর্থকষ্টে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ নারী-পুরুষ আত্নহত্যা করেন।
পুলিশ প্রশাসনকেও ভাবাচ্ছে আত্নহত্যা :
সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, প্রতিটি আত্নহত্যার ঘটনা সমাজকে নাড়া দিয়ে যায়। এটা পুলিশ প্রশাসনকেও ভাবাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে কী করা যায় তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মোতাবেক পদক্ষেপ নিয়ে এগোচ্ছে পুলিশ। আশা করছি দ্রুত এর সুফল আসবে।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া আত্নহত্যার ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণে দেখা যায় নগরীর শ্রমিক প্রবণ এলাকা বন্দর ও ইপিজেড থানা এলাকায় আত্নহত্যার ঘটনা বেশি। এখানে মূলত পারিবারিক অশান্তি তথা স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, আর্থিক টানাপোড়ন, ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণেই আত্নহত্যার ঘটনা ঘটছে। তবে এর বিপরীত চিত্র খুলশীতে। অভিজাত এ এলাকাটিতে এক বছরে আত্নহননের ঘটনা ঘটেছে মাত্র একটি।
আইনজীবিদের মতে, পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ না করার কারণে আত্নহত্যার ঘটনা সাধারণত ইউডি (আননেচারাল ডেথ বা অপমৃত্যু) হিসেবেই যবনিকাপাত ঘটে। পুলিশের পক্ষ থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে যদি আত্নহত্যার মামলাগুলো তদন্ত করা যায় তাহলে বেশিরভাগ আত্নহত্যার প্ররোচনাকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতামত:
সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে আত্নহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। শুধু চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় চলতি বছরের এই সময়ে ২৫৯টি এবং গত বছর ৫২৬ জনের আত্নহত্যার ঘটনা রেকর্ড করা হয়। রেকর্ডের বাইরেও নিশ্চয় রয়েছে। এছাড়া জেলায় কতগুলো আত্নহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা শিউরে ওঠার মতো।
তিনি বলেন, আত্নহত্যা যারা করেছে তারা নিশ্চয়ই বিস্বাদ থেকেই করেছে। এ বিস্বাদের পেছনে পারিবারিক বিরোধ, পড়ালেখার চাপ, মোবাইল কেনা, যৌতুক নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এসব সমস্যা দূর করার বিষয়ে আমরা কোনো কাজ করছি না। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইনী ব্যবস্থার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। তাহলেই আত্নহত্যা কমে আসতে পারে।
উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী আত্নহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। প্রতি বছরই বাড়ছে আত্নহত্যার ঘটনা। যা ঘাতক ব্যাধি থেকেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০২২ সালের চেয়েও চলতি বছরে আত্নহত্যার ঘটনা বেড়ে যাবে।