বিজয় দিবসে শ্রদ্ধাভরে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করেছে চট্টগ্রামের মানুষ। সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগরীর উত্তর কাট্টলীতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
এছাড়া চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ড. জিয়াউদ্দিন, পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ ও জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমও স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা জানিয়েছে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠন।
স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, বিজয়ের ৫৩ বছরেও বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত হয়নি। ৫৩টি বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা এখনও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছি। এখনও মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের জন্য আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত হলে, আমরা আমাদের বিজয়ের প্রকৃত সুফল অর্জন করতে পারব।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের যে নিশ্চয়তা নেই এবং গণতন্ত্রের পথে যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা আমরা অতিক্রম করার চেষ্টা করছি। মানুষের মৌলিক অধিকার, কথা বলার স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার, আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং ভোটের অধিকার নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমরা যদি মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারি, গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয় তাহলে আমরা একটি গণতান্ত্রিক, সুন্দর, দুর্নীতিমুক্ত ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।
এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য, সংবিধান থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সংস্কারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে মানুষ তাদের কাক্সিক্ষত সংসদ সদস্যকে নির্বাচিত করতে পারবে এবং একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করতে পারবে।
মেয়র বলেন, আজ এই বিজয় দিবসটি আমাদের জন্য আরেকটি বিজয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেটা হলো ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আগস্টের বিজয়। এ বিজয় এবং বিজয় দিবসের মূল শিক্ষা হলো আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রয়োজনীয়তা। আজ আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি, তাহলে মানুষের হারানো গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে পারব। মানুষের মৌলিক অধিকার, যেমন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য এসব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
স্মৃতিস্তম্ভে পু®পস্তবক অর্পণ শেষে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, আমরা বিজয়ের ৫৪ বছরে পা দিয়েছি। ৭১ এর চেতনাকে ধারণ করে জুলাই ২৪ এর বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য কাজ করব। ফরিদা খানম এ সময় চট্টগ্রামে একটি স্থায়ী স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করার পরিকল্পনার কথা জানান।
পুস্পস্তবক অর্পনে তাঁর সাথে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক নোমান হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি অধিগ্রহণ) এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাদি উর রহিম জাদিদ এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. শরীফ উদ্দিনসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
এছাড়া বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানিয়েছে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠন। সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) সকালে নগরীর নিউমার্কেট এলাকার মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল এবং কলেজ চত্বরে অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এদিন সকাল থেকেই শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানায় চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্কসবাদী), ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিস, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, উদীচী, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ বিভিন্ন সংগঠন।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ড. মাহফুজুর রহমান বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা গত ৫৩ বছর ধরে কোনো সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারিনি। আজও সে অবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হবে। শাসন ব্যবস্থার কাঠামো সংস্কার ছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আমরা পাব না। নতুন প্রজম্মকে আহবান জানাবো আপনারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শাসন ব্যবস্থা কাঠামো সংস্কারের চিন্তাভাবনা করবেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ তার রাজনৈতিক, সামাজিক ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা লাভ করবে। ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো। ভেঙে একটি স্বাধীন দেশের শাসন কাঠামো করলে।আমরা মুক্তি পাব।
সিপিবি চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি অশোক সাহা বলেন, ১৯৭১ সালে যে স্বপ্ন নিয়ে লাখো-কোটি মানুষ বুকের রক্ত দিয়েছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর যে প্রগতির সূচনা বাংলাদেশে হয়েছিল সেটা এখন আর নেই। এখন অন্ধকারের দিকে আমাদের দেশ এগিয়ে চলছে। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের যে স্বপ্নসাধ একটি শোষণমুক্ত, লুটপাটমুক্ত বাংলাদেশ সেটা এখনও আমরা পাইনি। মুক্তির জন্য অনেক বলিদান হয়েছে। ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশকে লুটের রাজত্বে পরিণত করেছে। সেটার বিপরীতে প্রগতিশীল, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়টে একটি নতুন বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে হবে। এ নতুন শক্তি গড়ার মধ্যে দিয়ে আমাদের দেশের মানুষের যে সংকট সেটা নিরসন হবে।
মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সমন্বয়কারী সৈয়দ আবদুল গণি বলেন, বিজয় দিবসের ঐতিহ্য কখনও মুছা যাবে না। দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। আমরা স্বাধীনতা রক্ষার্থে তখনও যুদ্ধ করেছি, এখনও আত্নত্যাগ করছি। এখনও বিভিন্ন বৈষম্যবিরোধী কাজ চলছে। আমরা সজাগ আছি। কিন্তু আমাদের যে তরুণরা আছে তারা যদি সজাগ না হয় তাহলে স্বাধীনতা রক্ষা আরও কঠিন হয়ে যাবে। স্বাধীনতা রক্ষা করাই বড় এবং কঠিন কাজ।
প্রতিবছর বিজয় দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হলেও এবার সেটা হয়নি।