শনিবার- ২২ মার্চ, ২০২৫

চট্টগ্রামে দালাল ছাড়া পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তি

সক্রিয় উপপরিচালকের সংঘবদ্ধ চক্র

print news

অফলাইনে পাসপোর্টের আবেদন জমা নেয়ার কোন নিয়ম নেই। অনলাইনে করতে হয় সব আবেদন। তবুও এই নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রতিদিন হাজারো পাসপোর্টের আবেদন নেওয়া হচ্ছে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে অবস্থিত জেলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে।

এ জন্য সরকারি নির্ধারিত ফি‘র অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে ১৭০০ টাকা। যা দালালদের মাধ্যমে নেয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত টাকা আদায়ের পর দালালরা আবেদনে মার্কার বা সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে আবেদনপত্র জমা দেয়ার জন্য পাঠায় পাসপোর্ট অফিসে। আবেদনকারীর তথ্যমতে, দালালের এই মার্কার ছাড়া মিলছে না পাসপোর্ট।

যার প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি। দালালের মার্কার ছাড়া আবেদন করে পাসপোর্ট করাতে গিয়ে পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে চরমভাবে হয়রানির শিকার হন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক পীরজাদা মো. মহরম হোসাইন। সর্বশেষ গত ২ অক্টোবর পাসপোর্ট অফিসের সহকারি পরিচালকের (এডি) হাতে লাঞ্ছিত হন তিনি।

এ বিষয়ে সাংবাদিক পীরজাদা মো. মহরম হোসাইন বলেন, গত ১ অক্টোবর রবিবার নিজের পাসপোর্ট করার জন্য এডি জাকির হোসেনের কাছে গেলে তিনি আবেদনে লেখা ভুল হয়েছে জানিয়ে অফলাইনে নতুন করে আবেদন করতে বলেন। তাঁর কথামতো অফলাইনে আবেদন করে ২ অক্টোবর সোমবার দুপুরের দিকে পুনরায় তাঁর কাছে গেলে তিনি আমার আবেদনটি দেখতে গড়িমসি করেন এবং রুমের বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন।

আমি তাৎক্ষণিক বিষয়টি উপপরিচালক তারিক সালমানকে জানালে তিনি সাথে সাথে আবেদনটি দেখে ১০৪ নম্বর রুমে জমা দিয়ে ছবি তোলার জন্য বলেন। আমি ১০৪ নম্বর রুমে আবেদনটি জমা দিয়ে ছবি তোলার প্রস্তুতি নিলে সেই মুহুর্তে এডি জাকির হোসেন প্রবেশ করে উপস্থিত সবার সামনে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাকে বলেন, আমি পাঠানো ছাড়া একটি ফাইলও জমা নিবেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকজন পাসপোর্ট গ্রাহক বলেন, দালালের মার্কার ছাড়া পাসপোর্ট করাতে এসে একজন সাংবাদিক এখানে লাঞ্ছিত হয়েছেন। সেখানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অবস্থা কি সেটা বলার দরকার আছে?

বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) সকালে এ অফিসে পাসপোর্ট করাতে আসেন রবিউল আলম নামে এক ব্যক্তি। পাসপোর্টের আবেদন কিভাবে করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দালাল ছাড়া আবেদন করলে তো পাসপোর্ট পাওয়া যায় না। তাই দালাল ধরে আবেদন করেছি।

তিনি বলেন, সকালে নগরীর চকবাজারে অনলাইনে আবেদন করে প্রিন্ট কপি নেওয়া হয়। সে কপিতে দালাল একটি সীল মেরে দেয়। এটিই তার মার্কার। এই কপি জমা দিতে এসেছি। আবেদনের কপির ছবি নিতে চাইলে তিনি অনুনয়-বিনয় করে বলেন, ভাই আমার ক্ষতি করিয়েন না। আপনি নিউজ করলে আমি পাসপোর্ট পাব না।

সামশুল হক নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমিও দালাল ছাড়া আবেদন জমা করতে এসেছি। ১০ বছর মেয়াদের পাসপোর্টের জন্য করা এই আবেদন কপি উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখে তারা বলেন, আবেদন না কি ভুল হয়েছে। অফলাইনে তারা আবেদন করতে বলেন। আবেদন ঠিকভাবে করতে তারা খোকন নামে একজনের সাথে দেখা করতে বলেন। তার সাথে দেখা করার পর সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে আরও ১৭০০ টাকা নেন তিনি।

Ctg Passport 05.10 1

একই কথা বলেন নাছির উদ্দিন, আমিনুর রহমান, আব্দুস সবুর, প্রিয়তোষ চক্রবর্তি, মণিলাল দাশ, ঝর্ণা রানিসহ বেশ কয়েকজন পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে আসা ব্যক্তি। তাদের অনেকেই ৫ বছরের জন্য পাসপোর্টের আবেদন ফি ৪ হাজার ৭৫ টাকার স্থলে ৫ হাজার ৮০০ টাকা দিয়েছেন বলে জানান।

ভুক্তভোগীরা জানান, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পাসপোর্ট করা নিয়ে শত শত দালাল সক্রিয় রয়েছে। এমনকি খোদ পাসপোর্ট অফিসেও সক্রিয় রয়েছে ১৫-২০ জন দালাল। যারা পাসপোর্ট অফিসের ডেস্কে বসে কাজ করেন। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-শহীদুল ইসলাম খোকন ওরফে খোকন, রিদোয়ান, রুহুল আমিন, রিপন, বাবুল, টিটু ও ইদ্রিছ। যাদের মার্কার ছাড়া পাসপোর্ট মিলে না এই অফিসে। দালালরা সত্যায়নের নামে মার্কার হিসেবে ব্যবহার করেন ডাক্তার বা ব্যাংকারদের সীল।

এদের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, দালাল শহীদুল ইসলাম খোকন ৩০৪ নন্বর কক্ষে ডেস্কে বসে দালালির কাজ করছেন। রুহুল আমিন ৩০৭ নম্বর রুমে ডে্েস্ক বসে কাজ করছেন। মোবাইলে তাদের ছবি তোলতে দেখে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। ফলে সাংবাদিকের উপস্থিতির খবর ছড়িয়ে পড়লে অন্য দালালরা গা ঢাকা দেন।

এ সময় শহীদুল ইসলাম খোকন ক্ষুব্দ হয়ে বলেন, আমরা এখানকার ডেইলি লেবার। এখানে আমরা এমনে-এমনে আসিনি। অনেক চড়াই-উতড়াই শেষে এসেছি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সুযোগ না দিলে কি আমরা এখানে আসতে পারতাম?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, অফিসের ভেতরে কাজ করেন এমন অন্তত ১৫-২০ জন দালাল রয়েছে। এদের অধিকাংশই এক সময় এই অফিসে আনসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ অবস্থায় দালালির কারণে তাদের চাকরি চলে যায়। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের ডেস্কে বসিয়ে দালালি করার সুযোগ করে দেয়। এর মধ্যে দালাল ইদ্রিছ আনসার হিসেবেও কর্মরত আছেন।

সূত্রমতে, পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন অফলাইনে এক হাজার থেকে ১২০০ পর্যন্ত আবেদন জমা পড়ে। প্রতিটি আবেদন থেকে দালালের মাধ্যমে অতিরিক্ত ১৭০০ টাকা আদায় করা হয়। আবেদনের প্রতিটি থেকে ১২০০ টাকা উপপরিচালকের পকেটে চলে যায়। সে হিসেবে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৩ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন উপপরিচালক তারিক সালমান। বাকি আবেদনের প্রতিটির ৫০০ টাকা অর্থাৎ মোট আবেদন থেকে আসা ৫-৬ লক্ষ টাকা ভাগ করেন সহকারি পরিচালক, রেকর্ড কিপার ও দালালরা।

এছাড়া এমআরপি (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) আবেদন বন্ধ থাকলেও নেয়া হচ্ছে সেই আবেদনও। যেখান থেকে প্রতিটি আবেদনে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এমনকি জরুরি পাসপোর্টের আবেদনেও সমপরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক তারিক সালমান বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা। এখানে কোন দালাল নেই। খোকন, রুহুল আমিন, রিপন নামে কাউকে আমি চিনি না। তাছাড়া পাসপোর্টের আবেদনে কোন মার্কার নেই। যারা আপনাকে এসব অভিযোগ করেছে তাদেরকে আমার কাছে নিয়ে আসেন।

অফলাইনে আবেদন জমা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অফলাইনে আমরা কোন আবেদন জমা নিই না। তবে অনলাইনে আবেদন করার পর যদি ভুল হয়, সেক্ষেত্রে অফলাইনে আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। আর আবেদনকারীরা অতিরিক্ত টাকা দিবেই বা কেন-উল্টো প্রশ্ন করেন তিনি।

এছাড়া এমআরপি ও জরুরি পাসপোর্টের আবেদন জমা নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এমআরপি আবেদন বন্ধ। আমরা এমআরপি আবেদন নিচ্ছি না। এমআরপি আবেদন জমা নেওয়ার প্রমাণ থাকার কথা জানালে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

তবে অফিসের এডি জাকির হোসেনের সঙ্গে কথা বলার পর বুঝা যায় উপপরিচালক তারিক সালমান তার বক্তব্যে যা বলেছেন তা সর্বৈব মিথ্যা। বিশেষ করে অফিসের ডেস্কে বসে কাজ করা দালাল শহীদুল ইসলাম খোকন ও রুহুল আমিনকে শনাক্ত করেন এডি জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ডিডি স্যার তাদের চিনে না বললে মিথ্যা বলেছেন। এক্ষেত্রে আমার কি করার আছে। এখানে স্যার যাই বলেন তাই। স্যার যদি বলেন, এটা পাসপোর্ট অফিস নয়, তাহলে পাসপোর্ট অফিস বলার সাধ্য আমাদের নেই। এর বাইরে তিনি অন্য কোন বিষয়ে কথা বলতে রাজী হননি।

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page