
টানা তাপ প্রবাহের পর গত মঙ্গলবার দিনগত মধ্যরাতে মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিপাত হয় চট্টগ্রামে। প্রায় ৪৫ মিনিটের এই বৃষ্টিপাতে ছিল ভয়ঙ্কর বজ্রপাতও। এতে শুধু তাপপ্রবাহ কমেছে তা নয়, কমেছে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির লবণাক্ততাও।
এছাড়া শুকিয়ে যাওয়া কাপ্তাই লেকেও পানি জমেছে কিছুটা। সেই সাথে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে কার্প জাতির মা মাছ নমুনা ডিমও ছেড়েছে। এই বৃষ্টিতে নানাবিধ এমন উপকারের সাথে উঁকি দিচ্ছে প্রাণঘাতি ডেঙ্গু রোগও।
এই বৃষ্টির পর গত বুধবার (১৭ মে) চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের এক প্রতিবেদনে ডেঙ্গু রোগীর ভয়াবহতার সতর্কতা জারি করা হয়। ওই সতর্কতায় বলা হয়, বৃষ্টি হওয়ায় সাথে সাথে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এ সময় চব্বিশ ঘণ্টার হিসাবে, চট্টগ্রাম মহানগরে ১১৪ জন এবং উপজেলা পর্যায়ে ২০৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর তথ্য প্রকাশ করে সিভিল সার্জন।
একইভাবে গত বৃহস্পতিবার (১৮ মে) সির্ভিল সার্জনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ওইদিন থেকে আগের চব্বিশ ঘন্টায় চট্টগ্রাম মহানগরে ১১৮ জন এবং উপজেলা পর্যায়ে ২০৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। একইভাবে সর্বশেষ শুক্রবার (১৯ মে) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম মহানগরে ১২১ জন এবং উপজেলা পর্যায়ে ২১৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছে।
সর্বশেষ প্রতিবেদনের হিসেব অনুযায়ী, আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর ৭৭ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে, ১২ জন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। অন্যান্য হাসপাতালে ৩২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এছাড়া উপজেলার মধ্যে ৪২ জন পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। যা সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি। আর আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৯ জন, মিরসরাইয়ে ১৬ জন, সীতাকুন্ডে ৫ জন, সন্দ্বীপে ১ জন, ফটিকছিড়িতে ২২ জন, হাটহাজারীতে ৭ জন, রাউজানে ৭ জন, বোয়ালখালীতে ২২ জন, কর্ণফুলীতে ১০ জন, চন্দনাইশে ২৮ জন, সাতকানিয়ায় ১৩ জন ও লোহাগাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন।
আর এই তিনদিনে মিলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নগরে ৩৩৩ জন এবং উপজেলা পর্যায়ে ৬২৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। যা উদ্বেগজনক হিসেবে বিবেচিত বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক শেখ ফজলে রাব্বি।
তিনি বলেন, এখনো মে মাস। বৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়েছে। তবে জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। এটা একটি প্রাণঘাতী ভাইরাস রোগ। সচেতন হলে এটি প্রতিরোধ করা যায়। এ জন্য আমাদের প্রথম দরকার ঘর-বাড়ি চারপাশ পরিষ্কার রাখা। এডিস মশা যেহেতু স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে তাই বাসার ফুলদানি, কোন অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোসা, কিংবা পরিত্যক্ত টায়ার থাকলে সেগুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলা।
তিনি আরও বলেন. আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যেন বাথরুমে বা অন্য কোথাও পাঁচদিনের বেশি পানি জমানো অবস্থায় না থাকে। এছাড়া ঘুমানোর আগে মশারি টাঙিয়ে নিতে হবে। কারো জ্বর হলে অবশ্যই ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। অবস্থা বেশি সিরিয়াস হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ওর্য়াডের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এম এ সাত্তার বলেন, বৃষ্টি হলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। এরপর বুধবার রাতে এবং বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কখনও হালকা, কখনো মাঝারি ধরণের বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে ক্রমেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত তিন দিনে চমেক হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মধ্যে এখনো ২০০‘র কাছাকাছি রোগী ভর্তি আছে। সুস্থ হয়েছে গুটি কয়েকজন মাত্র। এই রোগে আক্রান্ত হলে প্রচুর ঘানি পোহাতে হয়। মশা থেকে বাচার উপায় জানলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালেরর পরিচালক ডা. মোরশেদ হোসেন বলেন, গত তিন দিনে ৩৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এই রোগ অনেক কষ্টকর। রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি আমরা এডিস মশা থেকে রক্ষার বিষয়ে সচেতন করছি। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মশা প্রতিরোধের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বৃষ্টির সাথে এডিস মশার বংশ বিস্তার ঘটে। এডিস মশা যাতে বংশ বিস্তার করতে না পারে সে হিসেবে চসিক নগরীর নালা-নর্দমা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন কাজ চালাচ্ছে। একই সাথে মশক নিধনে প্রয়োজনীয় ওষুধ চিটানো জোরদার করেছে।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন হয়তো বাইরের নালা-নর্দমা পরিস্কার করছে। ওষুধ চিটাচ্ছে। তাতে ডেঙ্গু খুব একটা প্রতিরোধ হবে বলে মনে হয় না। কারণ ডেঙ্গুবাহি এডিস মশা শুধু নালা-নর্দমায় প্রজনন ঘটনায় না, বাসাবাড়ির ছাদ ও বাথরুমে জমানো পানিতেও প্রজনন ঘটায়। সুতাং বাসাবাড়ির ছাদ ও বাথরুমে পানি জমিয়ে রাখা ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে সবাইকে নজর দিতে হবে। তাহলেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব হবে।