মঙ্গলবার- ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

চট্টগ্রামে সবকিছুর সাথে ভুমি করও গিলছে অবৈধ ইটভাটাগুলো!

চট্টগ্রামে ভুমিকরও গিলে খাচ্ছে ৩৭৩ অবৈধ ইটভাটা!
print news

ট্টগ্রামে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে চলছে ৩৭৩ ইটভাটা। যেগুলো পাহাড়, সংরক্ষিত বনের গাছ, ফসলি মাটির সাথে গিলে খাচ্ছে সরকারের ভূমি উন্নয়ন করও (খাজনা)। চলতি বছর এসব ইটভাটা থেকে ধার্য্যকৃত ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) আদায় হয়েছে মাত্র ১৫ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪ টাকা। যা খাজনা আদায় লক্ষ্যমাত্রার ২৭ শতাংশ।

এখন পর্যন্ত ৭৩ শতাংশ খাজনা বকেয়া রয়েছে। দ্রুত বকেয়া ভূমি উন্নয়ন কর আদায় ও অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-ভূমি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম। কিন্তু একটি ইটভাটার বিরুদ্ধেও এ পর্যন্ত কোনরকম ব্যবস্থা নেয়নি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভুমি কর্মকর্তারা।

গত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম জেলা সমন্বয় সভার তথ্য পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জেলা প্রশাসনের হিসাবের তথ্য বলছে, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় সর্বাধিক ৭০টি, সাতকানিয়ায় ৫৩টি, রাউজানে ৪৭টি, ফটিকছড়িতে ৪৩টি, লোহাগাড়ায় ৪২টি এবং হাটহাজারী ও চন্দনাইশে ৩২টি, মিরসরাইয়ে ১৪টি, সন্দ্বীপে ১৬টি, সীতাকুন্ডে ৮টি, বোয়ালখালীতে দুটি, কর্ণফুলীতে ৮টি, আনোয়ারায় দুটি ও বাঁশখালীতে চারটি ইটভাটা রয়েছে। এরমধ্যে নগর ও জেলার পটিয়া উপজেলায় কোনো ইটভাটা নেই।

এসব ইটভাটা থেকে চলতি মৌসুমে (২০২৪-২০২৫) ভূমি উন্নয়ন কর দাবি করা হয় ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার ৪২৮ টাকা। এরমধ্যে শুধু গত বছরের নভেম্বর মাসে আদায় হয়েছে ৭ লাখ ৯১ হাজার ৫৫৭ টাকা। চলতি মৌসুমে সর্বমোট আদায় হয়েছে ১৫ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪ টাকা। সেই তথ্যে দেখা যায়, জেলার সীতাকুন্ড উপজেলায় শতভাগ খাজনা আদায় করা হয়েছে। তবে রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী, আনোয়ারা, সাতকানিয়া ও বাঁশখালী উপজেলায় কোনো অর্থ আদায় হয়নি।

মিরসরাই উপজেলায় ১৪ ইটভাটা থেকে দুই লাখ ১১ হাজার ৬৮০ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। এর বিপরীতে গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আদায় হয়েছে ১৩ হাজার ৩০০ টাকা। সীতাকুন্ড উপজেলায় আটটি ইটভাটায় ছয় লাখ ৩৯ হাজার ২৭৯ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। দাবির বিপরীতে শতভাগ খাজনা আদায় হয়েছে। সন্দ্বীপ উপজেলায় ১৬ ইটভাটা থেকে দুই লাখ ৪৪ হাজার ৬৪০ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে এক লাখ ৮৫ হাজার ৪৩৩ টাকা।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

ফটিকছড়িতে ৪৩ ইটভাটায় ১০ লাখ ৪৫ হাজার ৪ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে ৫৪ হাজার ৯৩২ টাকা। হাটহাজারী উপজেলায় ৩২ ইটভাটায় ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা। রাউজান উপজেলায় ৪৭ ইটভাটায় দুই লাখ ৬০ হাজার ৩০০ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে ৩৪ হাজার ২০০ টাকা। রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ৭০ ইটভাটায় ৫ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। দাবির বিপরীতে কোনো টাকাই আদায় হয়নি।

বোয়ালখালী উপজেলায় ২ ইটভাটায় ২২ হাজার ১৭৯ টাকার খাজনা দাবির প্রেক্ষিতে কোনো টাকা আদায় হয়নি। কর্ণফুলী উপজেলায় ৮ ইটভাটায় ৬৮ হাজার টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। আনোয়ারা উপজেলায় দুই ইটভাটায় ১৮ হাজার ৪৮০ টাকার খাজনা দাবির বিপরীতে কোন অর্থই আদায় হয়নি।

চন্দনাইশ উপজেলায় ৩২ ইটভাটায় চার লাখ ৭০ হাজার ৭৬৪ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে ৩৪ হাজার এক টাকা। সাতকানিয়া উপজেলায় ৫৩ ইটভাটায় ১০ লাখ ৭৪ হাজার ৫৬৭ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। এর বিপরীতে কোনো অর্থ আদায় হয়নি।

লোহাগাড়া উপজেলায় ৪২ ইটভাটায় ৫ লাখ ৫ হাজার ৪৪০ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে ৪৩ হাজার ৪০৯ টাকা। বাঁশখালী উপজেলায় চার ইটভাটায় এক লাখ ২৮ হাজার ৩৯৫ টাকার খাজনা দাবির প্রেক্ষিতে এক টাকাও আদায় হয়নি।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

সবমিলিয়ে ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার ৪২৮ টাকার বিপরীতে গত নভেম্বর মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ৭ লাখ ৯১ হাজার ৫৫৭ টাকা। যা মোট খাজনা আদায় লক্ষ্যমাত্রার ২৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ৭৩ শতাংশ খাজনা বকেয়া রয়েছে। অন্যদিকে এসব ইটভাটা ফসলি জমি, পাহাড়, সংরক্ষিত বনের গাছ কেটে সাবাড় করছে। পুড়িয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে পরিবেশ।

অভিযোগ রয়েছে, ইউএনও-ভুমি কর্মকর্তাদের সাথে ইটভাটা মালিক সমিতির দারুণ সখ্যতা রয়েছে। যাদের মাধ্যমে প্রতিবছর অর্ধকোটি টাকারও বেশি পকেটে ঢুকছে তাদের। সে কারণে কোনরকম লাইসেন্স ছাড়া সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ইটভাটাগুলো চললেও নাকের ডগায় তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছেন ইউএনও ও ভূমি কর্মকর্তারা।

গত ২৯ জানুয়ারি বুধবার চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নে কেবিএম ও সম্রাট নামে দুটি অবৈধ ইটভাটার চিমনিসহ কিলন ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। অভিযানে নেতৃত্ব দেন পরিবেশ সদর দপ্তরের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. রেজওয়ান-উল-কাদের। অথচ এই উপজেলায় ৭০টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে।

অভিযানে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মোজাহিদুর রহমান। তিনি বলেন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন ২০১৩ (সংশোধন আইন ২০১৯) এর কতিপয় ধারা লঙ্ঘন করায় রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নে মেসার্স আব্দুল করিম ব্রিকস (কেবিএম) ও একই এলাকার মেসার্স সৌদিয়া অ্যান্ড কোং (সম্রাট) ইটভাটার চিমনিসহ কিলন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। পরিবেশ রক্ষায় এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।

স্থানীয়রা জানান, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর, রাজানগর, লালানগর, হোসনাবাদ, চন্দ্রঘোনা কদমতলি, সরফভাটা, পোমরা ও কোদালা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ১২০টিরও বেশি ইটভাটা রয়েছে। যদিও পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, রাঙ্গুনিয়ায় ইটভাটার সংখ্যা ৭০টি। আর এসব ইটভাটায় প্রতিনিয়ত পোড়ানো হচ্ছে সংরক্ষিত বনের কাঠ ও টায়ার। এতে দুষণ হচ্ছে পরিবেশ। ইট তৈরীর উপকরণ হিসেবে ফসলি জমির টপসয়েল ও পাহাড় কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে। যা দেখেও নাকের ডগায় তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা প্রশাসন।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও দেশের শীর্ষ সংবাদপত্রগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধিরা পেশাদার রাঙ্গুনিয়া প্রেসক্লাবের নামে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট গড়ে তোলে দেশ ও পরিবেশ বিধ্বংসি এসব ইটভাটা সচলে সহযোগীতা করছে।

এ বিষয়ে জানতে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদুল হাসানের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে বৈষম্যবিরোধি ছাত্র জনতার আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের পর গঠিত ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির সাধারণ স¤পাদক ও বিএনপি নেতা ইউসুফ চৌধুরী বলেন, ইটভাটাগুলোর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে, কিন্তু নবায়ন হয়নি। সেই সূত্রে জেলা প্রশাসনেরও কোন অনুমোদন নেই।

এরপরও কীভাবে চলছে ইটভাটা জানতে চাইলে ইউসুফ চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও মানুষের জীবন-যাপনে ইটের প্রয়োজন আছে। সেই সূত্রে ইটভাটা চালু রাখা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামসহ সারাদেশে যেভাবে ইটভাটাগুলো চলছে সেভাবে রাঙ্গুনিয়ায়ও চলছে। তবে ইটভাটা নিয়ে কিছু কিছু গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশে আক্ষেপও প্রকাশ করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম জেলা ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির সভাপতি ও রাউজান পৌরসভার মেয়র মো. জমির উদ্দিন পারভেজ, সাধারণ স¤পাদক ইঞ্জিনিয়ার শামসুল আলম তালুকদারের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা গা ঢাকা দেন।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, দ্রুত বকেয়া ভূমি উন্নয়ন কর আদায় ও অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-ভূমি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষন ও পর্যালোচনায় রয়েছে। প্রয়োজনে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঈশান/মখ/বেবি

আরও পড়ুন

No more posts to show
error: Content is protected !!