শনিবার- ২৬ এপ্রিল, ২০২৫

চট্টগ্রামে ভ্যাপসা গরমে বেড়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং

বিপর্যন্ত জনজীবন

চট্টগ্রামে ভ্যাপসা গরমে বেড়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং

ট্টগ্রামে গত কয়েকদিন ধরে চলছে ভ্যাপসা গরম। এতে যখন মানুষের প্রাণ যায় যায় অবস্থা, ঠিক তখনই বেড়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিংও। এলাকাভেদে দিনে ও রাতে মিলে পাঁচ-ছয় ঘণ্টাও থাকছে না বিদ্যুত। ফলে চরম বিপর্যস্ত চট্টগ্রামের জনজীবন।

গত ১৫ এপৃল মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম মহানগরীর বুড়িশ্চর এলাকায় বিদ্যুতের লোডশেডিং চলাকালে ভ্যাপসা গরমে মারা গেছে নবজাতক এক কন্যা শিশু। কয়েক জায়গায় ঘটেছে হিটস্ট্রোকের ঘটনাও। গরমে কাহিল হয়ে নানা রোগে আক্রান্ত বিভিন্ন বয়সের রোগী প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালসহ নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে।

নগরবাসীর তথ্যমতে, গত রমজানে সরকার নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ করেছিল। রোজায় সেহেরীর সময়, ইফতারির সময়, নামাজের সময় বিদ্যুত যায়নি এক পলকও। মানুষ মনে করেছিল লুটেরা সরকারের পতনের পর বিদ্যুত খাতে সুবাতাস বইছে। কিন্তু গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে এলাকাভেদে বেড়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং।

নগরবাসীর অভিযোগ, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে করা হচ্ছে বৈষম্যও। পুলিশ, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা যেসব এলাকায় থাকেন, সেখানে অন্য এলাকার চেয়ে বিদ্যুতের লোডশেডিং কম। এর মধ্যে বিদ্যুতের লোডশেডিং সবচেয়ে বেশি করা হয় নগরীর চান্দগাঁও থানার বিভিন্ন এলাকায়।

চান্দগাঁও থানার মোহরা এলাকার বাসিন্দা নেজাম উদ্দিন জানান, এ এলাকায় দিনে ও রাতে মিলে পাঁচ ঘন্টা বিদ্যুত থাকে না। একবার বিদ্যুত গেলে আসে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা পর। ফলে এই এলাকার জনজীবন মারাত্বকভাবে বিপর্যন্ত। একইভাবে মুরগির খামার, গরুর খামারসহ বিভিন্ন কলকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিপর্যয়ের মুখে।

নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, ফরিদের পাড়া, সমশের পাড়া, বহদ্দারহাট এলাকাও বিপর্যস্ত বিদ্যুত লোডশেডিংয়ে। কালুরঘাট বিদ্যুত বিতরণ ইউনিট থেকে এসব এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়। এ বিষয়ে জানতে জানতে চাইলে কালুরঘাট বিদ্যুত বিতরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী গিয়াস ইবনে আলম বলেন, গরমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। সে তুলনায় বিদ্যুত উৎপাদন কম হচ্ছে। ফলে বিদ্যুতের লোডশেডিং করতে বাধ্য হচ্ছি আমরা।

নগরীর চাঁদগাও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, নগরীর অভিজাত নাসিরাবাদ আবসিক এলাকা, মৌসুমি আবািসক এলাকা, আগ্রবাদ এলাকায় বিদ্যুতের লোডশেডিং অনেকটা কম। তবে শহরের চেয়ে ভয়াবহ লোডশেডিং হচ্ছে পল্লীবিদ্যুত সমিতির আওতাধীন এলাকায়।

তিনি বলেন, আগে সরকার প্রধানের মুখে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কথা শুনতাম। এখন সেই বিদ্যুত কই। চট্টগ্রামের সব বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। অথচ গ্রিড থেকে চট্টগ্রামের জন্য দেওয়া হচ্ছে অর্ধেক। এটা বিমাতাসুলভ আচরণ।

নগরের ষোলশহর এলাকার গৃহিণী আবিদা সুলতানা (৩০) বলেন, গত কয়েকদিন ধরে সকাল ৯টার দিকে বিদ্যুত চলে যায়। এক ঘণ্টা পর এসে আবার বেলা ১১টায় চলে যায়। আধা ঘণ্টা বিদ্যুত থাকে। এরপর বেলা সাড়ে ১১টায় আসে। আবার বেলা তিনটায় যায়, আসে বিকেল ৫টায়। রাত ৮টায় যায়, সাড়ে ৯টায় আসে। এভাবে বিদ্যুত আসা-যাওয়া করছে। এতে ছোট বাচ্চা নিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছে।

নগরীর শুলকবহর এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, রমজানের শুরু থেকে ওয়াসার পানি নিয়ে কষ্টে আছি। এখন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে লোডশেডিং। সারা দিনে ছয় থেকে আটবার লোডশেডিং হচ্ছে। মধ্যরাতেও লোডশেডিং হওয়ায় প্রচন্ড গরমে বাসিন্দারা রাতে ঘুমাতে পারছেন না। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে সারারাত জেগে থাকতে হয়। এর মধ্যে বুড়িশ্চর এলাকায় আমার নিকট আত্নীয়ের এক নবজাতক শিশু কন্যা নিহত হয় গরমের কারণে। এ সময় ছিল না বিদ্যুত।

বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলের (বিতরণ) তথ্যেও মিল পাওয়া যায় বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের। তাদের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে নগরীর, চান্দগাঁও, বাকলিয়া ও কল্পলোক আবাসিক এলাকায়। এলাকাগুলো নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ জনপদগুলোর একটি।

এর বাইরে পাথরঘাটা, স্টেডিয়াম, ষোলশহর, মাদারবাড়ি, আগ্রাবাদ, হালিশহর, পাহাড়তলী, খুলশী, রামপুর, নিউমুরিং বিদ্যুত সরবরাহ কেন্দ্রগুলো পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করতে বাধ্য হচ্ছে। শহরের বাইরে বিদ্যুত সরবরাহ ইউনিট ফৌজদারহাট, হাটহাজারী, মোহরা, বাড়বকুন্ড, সন্দ্বীপ, পটিয়া, সাতকানিয়া, দোহাজারীতে তিন-পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুত বিতরণ বিভাগ (চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চল)।

তবে বিদ্যুত বিভাগের এই বিবরণের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই বলছেন ভোক্তারা। বুধবার (১৬ এপৃল) দুপুরে নগরের টেরি বাজারে কথা হয় মাইশা ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী মো. আলাউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার এই দোকান থান কাপড় ও থ্রি-পিচের জন্য বিখ্যাত। তবে লোডশেডিংয়ের কারণে এখন দোকানদারি করতেই কষ্ট হচ্ছে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই থাকে না বিদ্যুত। বিকল্প হিসেবে লাগানো হয় জেনারেটর। কিন্তু বিদ্যুতের চাপ বেড়ে যাওয়া তা নষ্টের পথে।

বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সিস্টেম কন্ট্রোল সূত্র জানিয়েছে, শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনে পিক আওয়ারে চট্টগ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল এক হাজার ২৮০ থেকে ৪০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে জাতীয় গ্রিড থেকে পাওয়া গেছে ৯০০ মেগাওয়াট। ফলে ওই সময়ে চট্টগ্রামে লোডশেডিং হয়েছে ৩৮০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট। এছাড়া সারা দিনে কমবেশি ২০০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে।

বিদ্যুৎখাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চাহিদার চেয়ে গ্যাসের সরবরাহ কম। তাই গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুত উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বিদ্যুত খাতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ২৩২ কোটি ঘনফুট। এবার গ্রীষ্মে পিডিবি অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের দাবি জানিয়েছে। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ৮৮ কোটি ঘনফুট। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি বসিয়ে রাখতে হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিদ্যুত বিতরণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী এম রেজাউল করিম বলেন, বিদ্যুত পরিস্থিতি নিয়ে আমরা নাজেহাল অবস্থায় আছি। জাতীয় গ্রিড থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুত সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। বুধবারও আমাদের চাহিদা ছিল সাড়ে ১২০০ মেগাওয়াটের বেশি, কিন্তু আমরা পেয়েছি ৯০০ মেগাওয়াট। ফলে বিভিন্ন এলাকায় রেশনিং করে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামে কয়েকটি পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ থাকার কারণে বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাউজান তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র, এখানকার ৪২০ মেগাওয়াটের ২টি বিদ্যুত কেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। পটিয়ার শিকলবাহা ২২৫ মেগওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র এবং ডুয়েল-ফুয়েল পদ্ধতির ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রটিও বন্ধ।

এছাড়া হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং সীতাকুন্ডের বাড়বকুন্ডে ২৪ মেগাওয়াটের রিজেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন উৎপাদন বন্ধ ১১০ মেগাওয়াটের এনার্জি প্যাক-এ। অপরদিকে পটিয়ায় ১১৬ মেগাওয়াটের আনলিমা পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ২১ মেগাওয়াট, শিকলবাহা জুডিয়াক পাওয়ার প্ল্যান্টে ৫৪ মেগাওয়াট, ১০৫ মেগাওয়াটের বারাকা পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ৮৫ মেগাওয়াট, ৫০ মেগাওয়াটের বারাকা পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ১২ মেগাওয়াট, ১১০ মেগাওয়াটের বারাকা কর্ণফুলী বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে ৩৩ মেগাওয়াট, কর্ণফুলীর ৩০০ মেগাওয়াট জুলধা বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে ১৭৭ মেগাওয়াট, দোহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে ৭৯ মেগাওয়াট, আনোয়ারার ৩০০ মেগাওয়াটের ইউনাইটেড পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ১৩০ মেগাওয়াট, ৫০ মেগাওয়াটের ইউনাইটেড পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ১৭ মেগাওয়াট, রাউজানে ২৬ মেগাওয়াটের আরপিসিএল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ১২ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page