দুই পাশে শুধু দোকান আর মার্কেট ভবন। আছে ট্রাক-মাইক্রো ও সিএনজি স্টেশন। আছে বসতির কলোনি। নিত্য বসে কাজীর হাট ও জান আলী হাটের পণ্য বেচাকানার বাজারও। আছে মাদকের কারখানা। যার পরিধি অনেক বড়। এসব অবৈধ স্থাপনার মাঝ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলে লক্কর-ঝক্কর রেল।
এমন পরিস্থিতি চট্টগ্রাম লোহাগাড়া ও কক্সবাজার রেলপথের কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে পূর্বে অন্তত দুই কিলোমিটার, যা কালুরঘাট সেতুর মুখ পর্যন্ত বিস্তৃত। পশ্চিমে রয়েছে আধা কিলোমিটার। আর দক্ষিণ পাশে চট্টগ্রাম-কালুরঘাট সড়ক থেকে উত্তরে অন্তত আধা কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এলাকায়।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জান আলী হাট রেলস্টেশনের চারপাশ ঘিরে এই বিপুল জায়গায় হাজার হাজার অবৈধ দোকানপাট, বসত ঘর ও বাজার বসিয়ে প্রতি মাসে এক থেকে দেড়কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন স্টেশন মাস্টার আবদুস সালাম। আর অবৈধ দখলে থাকা এই জমির বাজার মূল্য অন্তত হাজার কোটি টাকা বলে জানান স্থানীয়রা।
অবৈধ দোকানপাট, বসত ঘর, ট্রাক-মাইক্রো ও সিএনজি স্টেশন এবং বাজারের দোকান কিভাবে বসানো হল জানতে চাইলে সুবিধাভোগী কয়েকজনের সরলোক্তি-কেন? জান আলী হাট স্টেশনের মাস্টার আবদুস সালাম তো এই স্টেশনের অঘোষিত জমিদার। প্রতিমাসে এই স্ট্শেন থেকে তিনি এক থেকে দেড় কোটি টাকার মতো ভাড়া নেন। স্টেশনে কর্মরত ওয়েম্যান-পয়েন্টসম্যান, গেটকিপার ও আরএনবি সদস্যদের দিয়ে তিনি এসব ভাড়া কালেকশন করেন।
সুবিধাভোগীরা জানান, এই স্টেশনের অন্তত আড়াই কিলোমিটার এলাকায় ১০ হাজারেরও বেশি অবৈধ স্থায়ী দোকান ও মার্কেট রয়েছে। যেখান থেকে প্রতিমাসে তিনি এক কোটি টাকা ভাড়া পান। আর বসতঘর ও কাজীর হাট এবং জান আলী হাট বাজার থেকে প্রতিমাসে পান ৫০ লাখ টাকা। এই দুটি বাজার সকাল-সন্ধ্যা বসে। দিন হিসেবে এই দুটি বাজারের ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ভাড়া তোলা হয়।
এসব ভাড়ার টাকা রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় কমার্শিয়াল অফিসার (ডিসিও), বিভাগীয় ট্রান্সপোর্ট অফিসার (ডিটিও), আরএনবির ইনেসপেক্টর, জিআরপি, আরএনবি চিফ, কমার্শিয়াল চিফ ম্যানেজার (সিসিএম), রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস) ও মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পর্যন্ত ভাগবাটোয়ারা হয়।
জানতে চাইলে সুবিধাভোগী শুটকি বিক্রেতা নাসির উদ্দিন বলেন, আমি এই কাজীর হাটে ৭ বছর ধরে শুটকি বিক্রী করি। এ জন্য দৈনিক ৫০০ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। জান আলী হাট স্টেশন থেকে লোক এসে ভাড়া নিয়ে যাই। রেললাইনে উত্তর পাশে সারি সারি দোকানের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিমাসে আমি ৩০ হাজার টাকা দোকান ভাড়া দেই। স্টেশনের আরএনবির লোক এসে মাসিক ভাড়া নিয়ে যায়।
ব্যবসায়ীরা বলেন, এখানে শুধু দোকানপাট বা বাজার বসে না, এই স্টেশনের জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে মাদকের কারখানাও। গড়ে তোলা হয়েছে সিএনজি স্টেশন ও সিএনজি চালকদের অফিসও। আছে ট্রাক ও মাইক্রো স্টেশনও। যেখান থেকে প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের ভাড়া নেন স্টেশন মাস্টার আবদুস সালাম।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, স্টেশন মাস্টার আবদুস সালাম এতবড় সাম্রাজ্য সামলাতে স্থানীয় বখাটে দুস্কৃতিকারীদেরও নিয়োজিত করেছেন। যারা ভাড়া নিয়ে কোন সমস্যা হলে ব্যবসায়ীদের হুমকি-ধমকি ও মারধর করে। এমনকি এ নিয়ে স্থানীয়রা কোন প্রতিবাদ করলে তাদের উপর চালায় নির্যাতন। পাশাপাশি কাপ্তাই রাস্তা মাথা পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশও এসব অবৈধ দোকান থেকে মাসোহারা আদায় করেন।
এ কারণে এই স্টেশনের অবৈধ কর্মকান্ড নিয়ে সাংবাদিকরা পর্যন্ত নাক গলাতে পারে না। এই সাম্রাজ্যের অবৈধ দোকান, ট্রাক-মাইক্রো ও সিএনজি স্টেশনের ছবি তুলতে গিয়ে অনেক সাংবাদিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে। আবার জাতীয় ও চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত বড় পত্রিকা ও বড় বড় টিভি চ্যানেলের কিছু সাংবাদিককে মাসোহারা দিয়ে এ সাম্রাজ্য চালাচ্ছেন স্টেশন মাস্টার আবদুস সালাম।
এ বিষয়ে জানতে সম্প্রতি কথা হয় স্টেশন মাস্টার আবদুস সালামের সাথে। প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্বীকারোক্তি দেন, স্টেশনের বিপুল জায়গা অবৈধ দখলে চলে গেছে, এটা সত্য। যেখানে হাজার হাজার দোকানপাট, মার্কেট ভবন গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে ট্রাক-মাইক্রো ও সিএনজি স্টেশন। গড়ে উঠেছে মাদকের কারখানা, বড় দুটি হাটে নিত্য বসছে বাজার। যেখান থেকে মাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
তবে এই টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সাথে তিনি জড়িত নন বলে জানান। তিনি জোড় গলায় দাবি করেন, কেউ যদি বলে আমি কোন দোকানপাটসহ অবৈধ কোন স্থাপনা থেকে কোন সময় এক টাকা নিয়েছি, তাহলে আমি এই স্টেশন ছেড়ে চলে যাব।
কারা এসবের সাথে জড়িত জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্টেশনের জায়গা বা সম্পত্তি পাহারা দেয় রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি)। আরএনবি কর্মকর্তারা এসব অবৈধ স্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের সাথে জড়িত রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মী পরিচয়ে কিছু দুস্কৃতিকারী। তারাই দোকানপাট, মার্কেট ভবন, মাদকের কারখানা, ট্রাক-মাইক্রো ও সিএনজি স্টেশন এবং বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা তোলেন। গত ৫ আগস্টের আগে এসব কাজে ছিলেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ পরিচয়ে দুস্কৃতিকারীরা। এখন তোলছেন বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল পরিচয়ে দুস্কৃতিকারীরা।
আবদুস সালাম আরও বলেন, এসব ঝঞ্জালের কারণে আমি এখান থেকে ট্রান্সপার হয়ে চলে যেতে চাচ্ছি অনেকদিন ধরে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাকে কোনভাবে ট্রান্সপার করছেন না। আমার বাড়ি সীতাকুন্ড। আমি ওইদিকে চলে যেতে পারলে খুশি হতাম। পারলে আমাকে সেটা করে দেন। কিন্তু চট্টগ্রামে কত বছর ধরে আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাকরির বয়স ২০-২১ বছর তো হয়েছে। পুরো সময় চট্টগ্রামেই ছিলাম। তাহলে এবার চট্টগ্রামের বাইরে থেকে ঘুরে আসেন এমন কথা বললে তাতে তিনি অসম্মতি জ্ঞাপন করেন।
এক পর্যায়ে তিনি বলেন স্টেশনের অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদের জন্য আমি রেলওয়ের এস্টেট বিভাগে একাধিক চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তারা কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। দু‘বছর আগে এ নিয়ে একটা নিউজ হয়েছিল। তখন কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ অভিযানও করেছিল। একই সাথে আমিও হয়রানির শিকার হয়েছি। উচ্ছেদের পর সব আবার দখল হয়ে যায়। এ সময় তিনি নিউজ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, নিউজ করে কি লাভ? নিউজ না করার জন্য আমি কি করতে পারি বলুন।
পরে আবদুস সালামের বক্তব্য ধরে স্টেশনের এক কর্মচারি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্টেশন মাস্টার আবদুস সালাম যা বলেছেন, সব মিথ্যে। তিনিই পুরো জান আলী হাটের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি এই স্টেশন গত ৫-৬ বছর ধরে আঁকড়ে আছেন। বদলি করলেও তিনি টাকার বিনিময়ে তা কাটিয়ে আসেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আরএনবির পরিদর্শক রেজওয়ান হাসান বলেন, জান আলী হাট স্টেশনে আরএনবির কোন লোকই নেই। ষোলশহর স্টেশনে মাত্র দু‘জন আরএনবির সদস্য আছেন। জান আলী হাট স্টেশন তাদের দেখাশুনার দায়িত্ব আছে। কিন্তু ষোলশহর স্টেশনের ব্যস্ততার কারণে তারা তা দেখাশুনা করতে পারেন না। আরএনবি নিয়ে স্টেশন মাস্টার যা বলেছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বরং সুবিধাভোগীরা যা বলেছেন, সেটাই সত্য।
এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের আরএনবির চিফ আশাবুল ইসলাম এর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) সাক্ষাতের জন্য অফিসে গিয়ে জানা যায়, তিনি ছুটিতে আছেন। সে কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস) মো. শহিদুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তিনিও কল রিসিভ করেননি। হুয়্যাটস অ্যাপে নিউজ সংক্রান্ত কথা বলার জন্য ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনরকম রেসপন্স করেননি।
(বি: দ্র : শীগগীর আসছে ভিডিও কনটেন্ট নিউজ। প্রিয় পাঠক চোখ রাখুন দৈনিক ঈশানে)
এ সংক্রান্ত আরও নিউজ :-