গত কয়েক মাস ধরেই চিনি ও ভোজ্যতেল নিয়ে অস্থিরতা চলছে দেশের বাজারে। সরকার নির্ধারিত দরের চেয়েও বাড়তি দামে বিক্রয় হচ্ছে চিনি ও ভোজ্যতল। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার (১১ মে) কেজি প্রতি ১৬ টাকা বাড়িয়ে চিনি খোলা বাজারে ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১২৫ টাকা বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
আর এর আগেই বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। বিশ্ববাজারে পণ্য দুটির বুকিং রেট বৃদ্ধি ও ডলার সংকটে পর্যাপ্ত আমদানি সংকট দেখিয়ে ভোজ্যতেল ও চিনির বাজারের পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তোলে ব্যবসায়ীরা। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস হচ্ছে না চিনি ও ভোজ্যতেল বোঝাই ১০টি জাহাজ। অন্তত ২১ দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত বহি:র্নোঙরে ভাসছে অপেক্ষমাণ এসব জাহাজ।
বৃহস্পতিবার (১১ মে) চট্টগ্রাম বন্দরের বার্থিং লিস্ট পর্যালোচনা করে সাগরে পণ্যবোঝাই ১০ জাহাজ ভাসার তথ্য জানিয়েছে বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম বন্দরের শিপ হ্যান্ডলিং ও বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম শামসুজ্জামান রাসেল।
তিনি বলেন, সাগরে ভোজ্যতেল ও চিনির বেশ কিছু জাহাজ রয়েছে। কিছু জাহাজ দেরিতে খালাস কার্যক্রম শুরু করেছে। আর কিছু জাহাজ এখনও অলস বসে আছে। অনেক আমদানিকারক কৃত্রিম সংকট তৈরি কিংবা বেশি দামে পণ্য বিক্রির জন্য ইচ্ছা করেই পণ্য খালাসে দেরি করার কথা শোনা যায়। অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে দর বাড়বে এমন খবরে এলসি না খুলেই পণ্য নিয়ে আসেন। এ রকম ঘটলে ব্যাংকগুলো দায় নিতে চায় না। এ ক্ষেত্রে কী ঘটেছে তা জানা নেই।
বন্দরের বার্থিং লিস্ট পর্যালোচনা করে তিনি জানান, মেঘনা গ্রুপের এমভি কুইন সাফাহার সাড়ে ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি নিয়ে বন্দরে আসে ১৭ এপ্রিল। চিনিবোঝাই এ জাহাজটি পণ্য খালাস করতে পারেনি এখনও। এরই মধ্যে গত সোমবার এই গ্রুপের ৫৪ হাজার ৩২৩ টন সয়াবিনের কাঁচামালবোঝাই আরেকটি জাহাজ এসেছে।
জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট ইউনাইটেড শিপিংয়ের পরিচালক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, বিদেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমতি না পাওয়ায় পণ্য খালাস শুরু করা সম্ভব হয়নি। তবে সয়াবিনের বীজবোঝাই জাহাজের পণ্য ওই দিনই খালাস শুরু হয়েছে।
এস আলম গ্রুপের ৫০ হাজার টন চিনি তৈরির কাঁচামাল নিয়ে এমভি এমিরা মিরো নামে একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। গত সোমবার জাহাজটি নোঙর করেছে। একই গ্রুপের ৫২ হাজার ৫০০ টন অপরিশোধিত চিনিবোঝাই আরও একটি জাহাজ আছে বন্দরে। ২৫ এপ্রিল নোঙর করা এই জাহাজের খালাস কার্যক্রম এখনও শেষ হয়নি।
জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট প্যাসিফিক শিপিংয়ের কর্মকর্তা মো. শরীফ বলেন, এখনও ১০ হাজার টন চিনি খালাস হয়নি। এটির খালাস শেষ হলে গত সোমবার নোঙর করা আরেকটি জাহাজ থেকে পণ্য খালাস শুরু হবে। গত রোববার ৩০ হাজার টন চিনি তৈরির কাঁচামাল নিয়ে এমভি হংসিন ওসান নামে আরেকটি জাহাজ বন্দরে এসেছে। এই জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট ব্যানকন শিপিং। এছাড়া গত এপ্রিলে ৩০ হাজার টন চিনির কাঁচামালবোঝাই আব্দুল মোনেম গ্রুপের একটি জাহাজকে ডলার সংকটের কারণে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ২০ দিন ধরে। এ নিয়ে সাগরে এখন চিনিবোঝাই জাহাজ আছে তিনটি।
এছাড়া সিটি গ্রুপের এমভি কমন এটলাস ৫৬ হাজার ১৯৩ টন সয়াবিনের বীজ নিয়ে এসে সাগরে ভাসছে। গত সোমবার বন্দরে নোঙর করলেও পণ্য খালাসের অনুমতি পায়নি। জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট সেইফ শিপিংয়ের পরিচালক আনোয়ার জাবেদ বলেন, ডলারে এলসি মূল্য বুঝে না পাওয়ায় বিদেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান পণ্য খালাসের ছাড়পত্র দেয়নি। এ কারণে পণ্য খালাসে দেরি হচ্ছে।
এছাড়া আরবি গ্রুপ ও মাহবুব গ্রুপের এমভি জিন হাই টনে ব্রাজিল থেকে সয়াবিনের বীজ নিয়ে আসা এমভি জিন হাই টন জাহাজটি ভাসছে সাগরে। সোমবার চট্টগ্রাম বন্দর সীমায় নোঙর করলেও এটির খালাস প্রক্রিয়া কবে শুরু হবে, তা জানে না স্থানীয় শিপিং এজেন্ট এশিয়া বাল্ক মেরিটাইম। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন মজুমদার বলেন, এলসি নি®পত্তি না হওয়ায় পণ্য খালাসের অনুমতি দিচ্ছে না রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া এমভি ডিএমসি নেপচুন থেকে হচ্ছে না সয়াবিন খালাস এমভি ডিএমসি নেপচুন জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট মাল্টি পোর্ট শিপিং। এতে আছে ১২ হাজার টন সয়াবিন তৈরির কাঁচামাল। ৬ মে নোঙর করলেও পণ্য এখনও খালাস হয়নি।
মাল্টি পোর্ট শিপিংয়ের পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন, কিছু পণ্যের খালাসে অনুমতি মিললেও বাকিগুলোর ছাড়পত্র আসেনি। পণ্য আমদানি করেছে নারিস এগ্রো। এছাড়া ৩৪ হাজার ৪০০ টন সয়াবিনের কাঁচামালবোঝাই এমভি লরেন্স জর্জ নামের আরেকটি জাহাজ বন্দরে নোঙর করেছে ১০ এপ্রিল। এই জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট আইএমএস শিপিং। এ জাহাজেরও সব পণ্য খালাস হয়নি। এমভি লরেন্স জর্জে ৩৪ হাজার ৪০০ টন সয়াবিন তেলের কাঁচামালবোঝাই রয়েছে।
জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট আইএমএস শিপিং। তবে তাদের হয়ে পণ্য খালাসের চেষ্টা করছে বার্ডস বাংলাদেশ। এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সৈয়দ মাহমুদুল আহসান বলেন, জাহাজটি এসেছে এক মাস আগে। পণ্য খালাসে ১০ থেকে ১২ দিন লাগার কথা। ব্যাংক দায় পরিশোধ করতে না পারায় খালাস শুরু হয়নি।
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম জুয়েল বলেন, একেকটি জাহাজকে নাবিক ক্রুদের বেতন ও জ্বালানিসহ প্রতিদিন খরচ গুনতে হয় অন্তত ২০ থেকে ৩০ হাজার ডলার। এভাবে ডলার সংকটে জাহাজ দিনের পর দিন অপেক্ষা করলে দেশেরও সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। জরুরি ভিত্তিতে এ পরিস্থিতির সমাধান দরকার। অন্যথায় বাংলাদেশে জাহাজ পাঠাতে অতিরিক্ত সারচার্জ আরোপ হতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা জানান, ব্যাংকে এলসি খোলা তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। নানাভাবে চেষ্টা বা অনুরোধ করে ছোট অঙ্কের কিছু এলসি খোলা যাচ্ছে। তবে ডলার সংকটে বিদেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের আমদানি দায় পুরোপুরি মেটানো যাচ্ছে না। ফলে আটকে রয়েছে পণ্য খালাস।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, ডলার সংস্থান করার পর যাতে ব্যাংক এলসি খোলে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। ফলে এখন অনেক আমদানিকারকের এলসি খুলতে না পারার ঘটনা ঘটলেও একবার এলসি খোলার পর ডলার সংকটজনিত কারণে পণ্য খালাস করতে না পারার কথা নয়।
সূত্র জানায়, মাঝে ব্যাংকগুলোর ডলারের নেট ওপেন পজিশন (এনওপি) ৬০ কোটি ডলার নেগেটিভ হয়েছিল। আমদানি কমানোসহ বিভিন্ন কারণে এখন তা ১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার ইতিবাচক। আবার ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে ৩৩৬ কোটি ডলার। ফলে এ সময়ে ডলার সংকটে দায় পরিশোধে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলোতে ডলার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সব সময়ই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিত্যপণ্যের এলসি খুলতে বলা হয়েছে। ফলে ডলার সংকটের কারণে বন্দরে জাহাজ আটকে থাকার কথা না।
ভোক্তা-সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, কৌশলী আমদানিকারকরা চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর অপেক্ষায় রয়েছেন। দাম বাড়লে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করবেন তাঁরা। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাড়তি দাম পাওয়ার আশায় আমদানিকারকরা পণ্য খালাসে দেরি করছেন কিনা, তাও খতিয়ে দেখা উচিত।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, ব্যবসায়ীরা কখনও ক্ষতির টাকা নিজের পকেট থেকে দেয় না। বরং দ্বিগুণ হারে আদায় করবে ভোক্তার পকেট থেকে। তাই ডলার সংকটের সুরাহা হওয়ার দরকার জরুরি ভিত্তিতে। তবে বেশি দাম পাওয়ার আশায় আমদানিকারকরা কৌশলে পণ্য খালাসে দেরি করছে কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা উচিত।