বৃহস্পতিবার- ২৭ মার্চ, ২০২৫

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড গিলে খাচ্ছে চেয়ারম্যান-উপসচিব চক্র, নেপথ্যে নওফেল

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড লুটে খাচ্ছে চেয়ারম্যান-উপসচিব সিন্ডিকেট, নেপথ্যে নওফেল
print news

সএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল জালিয়াতি, নাম সংশোধন, নিয়োগ বাণিজ্য, সংস্কার ও মেরামত প্রকল্প বাস্তবায়ন, টেন্ডার বাণিজ্য, আভ্যন্তরীণ উপকরণ কেনাকাটা, বাজেট অনুমোদন, টিএডিএসহ সবকাজে নানা অনিয়ম ও কৌশলের মাধ্যমে সরকারি অর্থ লুটপাট হচ্ছে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে। আর এসব কাজে সরকারি অর্থব্যয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্তরা হচ্ছেন চেয়ারম্যান, সচিব ও উপসচিব।

যারা সুযোগের সদ্বব্যবহার করে প্রতিনিয়ত হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ থেকে কোটি টাকা। যা করতে গিয়ে প্রমাণ সাপেক্ষে পেয়েছেন প্রতিষ্ঠানিক শাস্তিও। এরপরও ক্ষমতার কমতি নেই তাদের। যে দায়িত্বে থেকে অনিয়ম ও দূর্নীতির কারণে শাস্তি পেয়েছেন, ঘুরে ফিরে সে দায়িত্বে থেকে গিয়ে করে চলেছেন নানা অপকর্ম। যার জন্য সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন দূর্নীতিবাজ চক্র। আর এসবের নেপথ্যে রয়েছেন খোদ সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

এমন অভিযোগ শিক্ষাবোর্ডের অনিয়মবিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারিদের। তাদের ভাষ্য, চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর রেজাউল করিম গত ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বোর্ডের একটি মেরামত প্রকল্পের কাজের ঠিকাদার থেকে মোটা অংকের ঘুষ আদায় করেন। এরমধ্যে সর্বশেষ ৫০ হাজার টাকা গ্রহণের বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। এ নিয়ে চট্টগ্রাম ও জাতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশ হয়।

পরে তিনি ওই টাকা শিক্ষাবোর্ডের ব্যাংক হিসাবে জমা দিয়ে বাচার চেষ্টা করেন। এ সময় তিনি শিক্ষাবোর্ডের সচিব পদের দায়িত্বে ছিলেন। আর এই ঘটনায় মন্ত্রণালয় থেকে শাস্তিমূলক বদলিও করা হয় তাকে। কিন্তু কয়েকমাস যেতে না যেতেই চলতি বছরের মে মাসে তিনি ফিরে আসেন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হয়ে। যা শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের কারিশমা বলে গুঞ্জন উঠে। আর এই পদায়নের জন্য অন্তত ২০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে।

আর তিনি চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নিয়েই শুরু হয় নানা অনিয়ম ও কলা-কৌশলের মাধ্যমে সরকারি অর্থ লুটপাটের খেলা। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে বদলি বাণিজ্য। যা তিনি সাবেক সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথের বদলির সুযোগ নিয়ে তড়িঘড়ি করে ফেলেন। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র নাথ ১৪ জুলাই বিকাল চারটায় বিদায় নেন। বিকাল সাড়ে চারটায় উপ-সচিব বেলাল হোসেন স্বাক্ষরিত চারজন কর্মচারিকে মাখা বদলির আদেশ করা হয়।

অথচ পরেরদিন ১৫ জুলাই বারটার সময় সচিব পদে যোগদান করেন প্রফেসর আমিরুল মোস্তফা। আর এ কাজে মূল কৌশলকারী হচ্ছেন বোর্ডের উপসচিব বেলাল হোসেন। যিনি বোর্ডের সকল অনিয়ম ও দূর্নীতির মূল হোতা হিসেবে খ্যাত। গত কয়েকবছর ধরে তিনি ছাত্রলীগের নেতা পরিচয়ে বোর্ডে প্রভাব বিস্তার করেন। যার ইন্ধনে বোর্ডে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল জালিয়াতি, নাম সংশোধন, নিয়োগ বাণিজ্য, সংস্কার ও মেরামত প্রকল্প বাস্তবায়ন, টেন্ডার বাণিজ্য, আভ্যন্তরীণ উপকরণ কেনাকাটা, বাজেট অনুমোদন, টিএডিএসহ সবকাজে নানা অনিয়ম ও কৌশলের মাধ্যমে সরকারি অর্থ হরিলুট চলছে।

কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অভিযোগ, চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নিয়ে প্রফেসর রেজাউল করিম চট্টগ্রামের প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা, সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের পিতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর কবর জেয়ারত করতে যান। এরপর উপ-সচিব বেলাল হোসেন স্বাক্ষরিত আদেশে বোর্ডের বিভিন্ন সেকশনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সরিয়ে পছন্দের অন্তত ২১ জন অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারিকে কয়েক দফায় বদলি করেন। বদলির আদেশ প্রাপ্তদের অধিকাংশই শাস্তি প্রাপ্ত। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ১ থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় করেন। এছাড়া করা হয় মাসোহারার চুক্তিও।

বেলাল হোসেন কর্তৃক বদলি হওয়া দুর্নীতি ও শাস্তিপ্রাপ্ত কর্মচারিরা হলেন-বিমল চাকমা, সেকশন অফিসার, হিসাব শাখা থেকে সংস্থাপন শাখা। তিনি স্টোর কিপার থাকায় অবস্থায় তদন্তে অভিযুক্ত। মো. জাহাঙ্গীর সেকশন অফিসার, হিসাব শাখা থেকে কলেজ শাখা। তিনি হাইকোর্টের রীট জালিয়াতির তদন্তে শাস্তি প্রাপ্ত। জাহেদ হোসেন, গ্রহণ ও প্রেরণ শাখা থেকে পরীক্ষা শাখা। তিনি বিদ্যালয় শাখায় তদন্তে শাস্তি প্রাপ্ত। তাঁর বেতন বৃদ্ধি ফাইল স্থগিত। মো. ইয়াছিন, অফিস সহায়ক; কলেজ শাখা থেকে চেয়ারম্যান দপ্তর। পরীক্ষা শাখায় তদন্তে শাস্তি প্রাপ্ত। তাঁর বেতন বৃদ্ধির ফাইল স্থগিত। আর এসব কর্মচারিদের কারণে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বোর্ডে বিভিন্ন কাজে আসা সেবা প্রার্থীরা। যারা নিরবে মুখ বুজে সহ্য করে টাকার বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

সম্প্রতি এমন কয়েকজন ভুক্তভোগীর সেবা প্রার্থীর সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তম্মধ্যে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থীর মা বলেন, আমার মেয়ের নাম ভুল হয়েছে। নাম সংশোধনের জন্য উপ-সচিব বেলাল হোসেন এক লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন। এভাবে প্রতিদিন নাম সংশোধন করতে আসা সেবাপ্রার্থীর কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। নাম সংশোধন ছাড়াও প্রতিবছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ফলাফল জালিয়াতি করেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন কর্মকর্তা-কর্মচারিরা।

এছাড়া শিক্ষাবোর্ডের আওতায় তিনটি আবাসিক ভবনে কর্মকর্তা-কর্মচারির ৩০টি পরিবার থাকেন। এই সকল ভবনের রক্ষাণাবেক্ষণ কমিটিতে শিক্ষাবোর্ডের উপ-সচিব বেলাল হোসেন স্বাক্ষরিত ৪ জুলাই তারিখের চিঠিতে চারজন কর্মচারির মধ্যে তিনজন শাস্তি প্রাপ্ত। এই শাস্তি প্রাপ্ত কর্মচারিরা হলেন- ওসমান গণি, সহকারি হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা। তিনি হাইকোর্টের রীট জালিয়াতির অপরাধে শাস্তি প্রাপ্ত। মো. জাহাঙ্গীর, সেকশন অফিসার। তিনিও হাইকোর্টের রীট জালিয়াতির অপরাধে শাস্তি প্রাপ্ত। জাহিদ হোসেন, উচ্চমান সহকারী। চেয়ারম্যানের ড্রাইভারের সাথে সরাসরিভাবে শাস্তি পেয়ে প্রমোশন বঞ্চিত হয়েছেন।

এছাড়া চলতি অর্থবছরে বাজেট অনুমোদন নিয়ে টিএডিএ দেখিয়ে একবার, বোর্ডের হিসাব থেকে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা উত্তোলন করে আরেকবার। আবার ৩০ হাজার টাকা করে প্রত্যেক কর্মকর্তার হিসাবে ট্রান্সফার দেখানো হয়। এভাবে সকল দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সিন্ডিকেটে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের সকল কর্মকান্ড। নতুন সচিব প্রফেসর আমিরুল মোস্তফা ও নতুন চেয়ারম্যান প্রফেসর রেজাউল করিম যোগদানের পর এই সকল দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের দৌরত্ব্য বেড়ে গেছে দ্বিগুণ হারে। ফলে শিক্ষাবোর্ডের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। কিন্তু সিন্ডিকেটের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারছে না।

উল্লেখ্য, গত ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে টেন্ডারের আওতায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড থেকে ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকার বিল পায় মাষ্টার সিমেক্স পেপার লিঃ শিট সরবরাহকারী নামক প্রতিষ্ঠান। ওই বছরের ৮ জুন বিল পাওয়ার সময় ঘুষ হিসেবে নগদ ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন শিক্ষাবোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান ও তৎকালীন সচিব প্রফেসর রেজাউল করিম।

আর বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর ঘুষের ওই টাকা অন্তত ৬ দিন পর ১৫ জুন তড়িঘড়ি করে শিক্ষা বোর্ডের ৫৯১ কোডে ব্যাংক হিসাবে জমা দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন। অভিযোগটি তখন স্বীকার করেছিলেন তৎকালীন শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর কামরুল আখতার। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মাঝে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলে। আর সেই সচিব চেয়ারম্যান পদে পদায়নের পর স্তব্দ হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা।

বদলি বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উপ-সচিব বেলাল হোসেন বলেন, বদলি বাণিজ্য সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই। আপনি চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলুন। আপনার স্বাক্ষরিত আদেশেই তো বদলি করা হয়-এমন কথার জবাবে তিনি বলেন, আমার স্বাক্ষরে হয়েছে তো কি হয়েছে? চেয়ারম্যান বললে তো আমাকে স্বাক্ষর করতে হবে।

বদলি বাণিজ্যে ঘুষ লেনদেন এবং অসৎ হিসেবে পরিচিত বিতর্কিত ব্যক্তিদের ঘুষের বিনিময়ে পদায়ন, নাম সংশোধনের কাজে মোটা অঙ্কের ঘুষ আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে উপ-সচিব বেলাল হোসেন বলেন, এসব কিছুই আমি জানি না। আপনি কিছু জানতে চাইলে চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলুন।

আর এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রামের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর রেজাউল করিমের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কোন সাড়া দেননি।

আজ ১২ আগস্ট সোমবার এ বিষয়ে আলাপ করার সময় চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের সহকারি হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ওসমান গণি বলেন, এখানে কোন বদলি বাণিজ্য হয়নি। বরং বদলি করা পদে আগে যারা ছিল তারা সাবেক সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথের সিন্ডিকেট। তারা দীর্ঘদিন ধরে এ পদে থেকে সুবিধে হাতিয়ে নিচ্ছেন। এখন বদলি করায় তাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আর নতুন সচিব যোগ দেওয়ার কয়েকমুহুর্তের মধ্যে এই বদলি কতটুকু নৈতিক প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, চেয়ারম্যান চাইলে সব কিছুই করতে পারেন। তিনি যে আদেশে সাইন করবেন সেটাই আইন। সে হিসেবে উপ-সচিব বদলি করেছেন। সেটা বেআইনি নয়।

উপ-সচিব বেলাল হোসেনের বিরুদ্ধে আরও নানা অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ অনিয়মের অভিযোগ তো কিছু আছেই। নাম সংশোধনে কিছু ফায়দা আছে-তবে আমার প্রশ্ন যারা নাম সংশোধন করতে আসেন তারা টাকা দেয় কেন? তাদের লাভ আছে বলেই তো দিচ্ছে। নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, শুধু কি এখানে দেখলেন, সেটা নেই কোথায়।

ক্ষুব্দ হয়ে তিনি বলেন, এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল জালিয়াতি করে সাবেক সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ যে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। নিজের ছেলের পরীক্ষার রেজাল্ট পর্যন্ত উল্টিয়ে দিয়ে ভাল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন সেটার তো কিছুই হলো না। বরং সব সচিব ও চেয়ারম্যান থেকে বর্তমান চেয়ারম্যান অনেক ভাল আমি সেটাই বলব। আর বর্তমান চেয়ারম্যানের একজন ভাই সেনাবাহিনীর মেজর সেটা কি আপনি জানেন। এমন কথা কেন বললেন-প্রশ্ন করা হলে সহকারি হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ওসমান গণি বলেন, না একটু স্মরণ করিয়ে দিলাম।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page