
২০০৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ছাত্রাবাসের বেলাল স্মৃতি মেস নামক ক্যান্টিনের দায়িত্ব নেন মো. রফিকুল ইসলাম। কিন্তু এ ক্যান্টিন থেকে আয় করে লাভের চেয়ে ক্ষতির পাল্লাই ভারী হয়েছে তার। কারণ ক্যান্টিনে ইচ্ছেমত খেলেও টাকা দিতেন না ছাত্রলীগ নেতারা।
অন্তত ৫০ জন নেতাকর্মীর খাবারের বিল বাবাদ তার বাকির খাতায় বকেয়া উঠেছে চার লাখ টাকারও বেশি। যারা গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর রয়েছেন আত্নগোপনে। এতে বাকি টাকা আদায়ও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আর অর্থ সংকটে পড়েছেন রফিকুল।
রফিকুলের ভাষ্য, গত ৫ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে খাবার খেয়ে টাকা না দিয়ে চলে যেতেন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। টাকা চাওয়ায় ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে তিনি মারধরের শিকারও হয়েছেন। বাকিখোরদের দলে ছিল প্রায় ৫০ জন। নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নাম বলতে চাননি তিনি। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ছাত্রলীগ নেতারা আত্নগোপনে চলে গেছেন।
রফিকুল জানান, ২০০৭ সালে তিনি ক্যান্টিন পরিচালনার দায়িত্ব নেন। গ্রাহক ছিল এমবিবিএস ৪৬তম ব্যাচ থেকে ৬২তম ব্যাচ এ সময়ের ছাত্ররা। সেই থেকে এই ১৭ বছরে ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা খেয়ে বিল পরিশোধ না করায় বকেয়া জমেছে ৪ লাখ টাকার ওপরে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে বকেয়া বিলের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ওই এক বছরে ছাত্রলীগের বাকির খাতায় লিখিয়েছে আড়াই লাখ টাকা।
রফিকুল জানান, প্রতিদিন সকালে খিচুড়ি, ডিম ওমলেট পাওয়া যায় ক্যান্টিনে, দাম ৪৫ টাকা। দুপুরের মেন্যুতে ফার্মের মুরগি, ভাত, ডাল, সবজির প্যাকেজ দাম নির্ধারিত ছিল ৮০ টাকা। দেশি মুরগি থাকলে দাম ৯০ টাকা। আর প্যাকেজে গরুর মাংস থাকলে দাম পড়ে ১০০ টাকা। সপ্তাহে পোলাও শুক্রবার ও খিচুড়ি নির্ধারিত রয়েছে মঙ্গলবার। এর সঙ্গে মাছ, সবজি, ভাত মিলে প্যাকেজ ৭০ টাকা।
ক্যান্টিনে খাবার দেওয়া শুরু হয় সকাল ৭টা থেকে ১০টা, দুপুরে সাড়ে ১২টা থেকে আড়াইটা ও রাতে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতারা নির্ধারিত সময়ের আগেই মেসে এসে রান্নাঘর থেকেই রান্না করা ভালো খাবারগুলো নিয়ে রুমে চলে যেতেন। পোলাও, গরুর মাংস কখনোই ছাত্রাবাসের সাধারণ ছাত্রদের কপালে জুটত না। বিল চাইলে ছাত্রলীগ নেতারা বলত, টাকা তো দিবই। না দিয়ে থাকব নাকি? দুই-তিন মাস পরপর এক-দেড় হাজার টাকা দিয়ে আবার বাকির খাতায় নাম লিখাত তারা।
বাকি টাকা আদায় প্রসঙ্গে রফিকুল বলেন, যারা বাকি খেয়েছে, তারা জানে কত টাকা বাকি খেয়েছে। আমি গরিব মানুষ। ক্যান্টিনে ব্যবসা করে সংসার চালাই। আমার টাকা যদি পরিশোধ করে আলহামদুলিল্লাহ। না দিলেও আলহামদুলিল্লাহ। কারণ আমি প্রতিবাদ করতে পারব না। আমাকে রাস্তাঘাটে মেরে ফেলে রাখবে। তাই আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখছি।
সাধারণ ছাত্ররা জানান, ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই খাবারের বিল চাওয়ায় ছাত্রলীগের একাংশের নেতা আসেফ বিন তাকির বেধড়ক পেটান রফিকুলকে। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ডা. সাহেনা আক্তারের কাছে লিখিত অভিযোগে রফিক চাঁদা না দেওয়ায় তাকে মারধর করা হয় বলে উল্লেখ করেন। তাকির তখন হাসপাতালের ইন্টার্ন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। এভাবে আরও দুবার টাকা চাইতে গিয়ে মারধরের শিকার হন রফিকুল।
তবে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা গা ঢাকা দেওয়ায় সাধারণ ছাত্ররা তাদের পছন্দমতো খাবার নিয়ে খেতে পারছেন বলে জানান। এদিকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাকি খাওয়াও বন্ধ ঘোষণা করেছে কলেজ প্রশাসন। কলেজ থেকে ছাত্রাবাসে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা হবে। এতে খাবারের মূল্য তালিকা কম রাখা হবে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হাবিব হাসান বলেন, আমরা ছাত্র ও ক্যান্টিন ব্যবস্থাপক রফিককে নিয়ে একটা কমিটি করে দিয়েছি। প্রতি সপ্তাহে কমিটির একেকজন রফিকের সঙ্গে বাজার করতে যাবে। তাহলে বাজারদরের প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে। কমিটির সুপারিশ মোতাবেক খাদ্য তালিকায় থাকা খাবারের দাম নির্ধারণ করা হবে। কলেজ থেকে ক্যান্টিনে ভর্তুকি দেওয়া হবে। যাতে খাবারের মান ভালো হয়। আর কোনোভাবেই ছাত্ররা ক্যান্টিনে বাকি খেতে পারবে না।