বুধবার- ২৬ মার্চ, ২০২৫

চিনির গুদামে আগুনের প্রভাব খাতুনগঞ্জে

সমালোচনার মুখে এস আলম গ্রুপ

চিনির গুদামে আগুনের প্রভাব খাতুনগঞ্জে
print news

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যা এলাকায় চিনির গুদামে আগুন লাগার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে। মঙ্গলবার সকাল থেকে পাইকারি চিনির দাম প্রতিকেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে এস আলম গ্রুপ।

বুধবার (৬ মার্চ) দুপুরে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ স¤পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের একমাত্র চিনির কারখানা হচ্ছে এস আলম সুগার মিল। যেখানে রোজার জন্য মজুদ করা এক লাখ টন চিনি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বাজারে কমবেশি এর প্রভাব তো পড়বেই। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মুখর খাতুনগঞ্জ।

তিনি জানান, সোমবার (৪ মার্চ) বিকেলে এস আলম সুগার মিলের গুদামে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আর মঙ্গলবার সকাল থেকেই খাতুনগঞ্জে প্রতিমণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ৫০ টাকায়। এর আগে সোমবার সকালে এই চিনি প্রতিমণ বিক্রয় হয়েছে ৪ হাজার ৯৩৫ টাকায়। যা কেজিপ্রতি ৩ টাকা বেশি।

আবার খুচরায়ও প্রভাব পড়েছে একই হারে। চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন হাটবাজারে মঙ্গলবার সকাল থেকে প্রতিকেজি চিনি বিক্রয় হচ্ছে ১৪৮ থেকে ১৫০ টাকায়। সোমবার সকালে এই চিনি বিক্রয় হয়েছে ১৪৫ থেকে ১৪৭ টাকায়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট্টগ্রামে একটি মাত্র চিনির কারখানা রয়েছে। সেই কারখানায় আগুন লেগেছে। আর সেই হিসেবে চিনির সংকট হবে মনে করে দাম বেড়ে গেছে।

খাতুনগঞ্জের চিনির বড় ব্যবসায়ী আর এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, এস আলম সুগার মিলে আগুন লাগাটা একটি দুর্ঘটনা। তার মানে অন্য মিলগুলোতে চিনির সংকট হওয়ার কথা নয়। সব মিলেই চিনি রয়েছে। এখন এস আলমের মিলে আগুন লাগার সুযোগ নেওয়ার পায়তারা করছে ঢাকার মিলগুলো। এতে চিনির দাম বাড়ছে

তিনি বলেন, খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীদের হাতে চিনির বাজার নেই। এখানকার ব্যবসায়ীরা চিনির দাম বাড়াতে-কমাতে পারেন না। মূলত ঢাকার মিলাররা দাম বাড়িয়ে দিলে খাতুনগঞ্জেও দাম বাড়ে। এখন সরকারের উচিত রোজায় ঢাকার মিলগুলো থেকে চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা।

ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, দেশে বছরে কমবেশি ১৮ থেকে ২০ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো থেকে আসে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টনের মতো। অবশিষ্ট চিনি আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর প্রায় ৯৮ শতাংশের বেশি চিনি আমদানি করতে হয়। দেশে ব্যক্তিখাতের পাঁচ শিল্পগ্রুপ সিটি, মেঘনা, এস আলম, আবদুল মোনেম লিমিটেড ও দেশবন্ধু সুগার মিল অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। পরে নিজেদের মিলে পরিশোধন করে এসব চিনি বাজারজাত করা হয়।

চিনি নিয়ে ছিনিমিনির হুশিয়ারি :
চিনির গুদামে আগুন লাগার ঘটনায় অসাধু ব্যবসায়ীরা চিনি নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদ।

ঘটনার পরদিন মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদ বলেন, আমাদের একটি গোডাউনে আগুনে লেগে চিনির কাঁচামাল পুড়ে গেছে। এগুলো অপরিশোধিত চিনি ছিল। কিন্তু এসবকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা দুই-একদিন চিনি নিয়ে কারসাজি করতে পারে।

তিনি বলেন, আমাদের কাছে ইতোমধ্যে সরবরাহ করার জন্য চিনির পর্যাপ্ত স্টক রয়েছে। উৎপাদিত চিনিও আছে। দুই-একদিন পর আমাদের উৎপাদন শুরু হয়ে যাবে। উৎপাদনে গেলে অসাধুদের খেলা পন্ড হয়ে যাবে।

১৫ রমজান পর্যন্ত চলবে চিনির মজুদ :
অগ্নিকান্ডের কারণে বাজারে চিনির দামে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ ও জেনারেল ম্যানেজার (করপোরেট) মোহাম্মদ আকতার হোসেন।

তারা বলেছেন, আমাদের শুধু একটা গোডাউনে আগুন লেগেছে। সেটিতে ক্ষয়ক্ষতি হলেও পাশে আরো গোডাউন রয়েছে। সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ চিনি মজুদ রয়েছে। আমাদের ৬-৭ লাখ টন চিনি পাইপলাইনে রয়েছে। এসব চিনি অন্তত ১৫ রমজান পর্যন্ত সরবরাহ করা যাবে। তবে দুয়েকদিনের মধ্যে উৎপাদনে গেলে চিন্তার কোনো কারণ থাকছে না।

এস আলম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত কুমার ভৌমিক ও এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের পাওয়ার প্লান্টের সহকারী ফিটার মনির বলেন, এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলসের দুটি প্লান্টে চিনি পরিশোধন করা হয়। এর মধ্যে প্লান্ট-১ এর উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ৯০০ টন। প্লান্ট-২ এর উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৬০০ টন। থাইল্যান্ড এবং ফ্রান্সের প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তায় কারখানাটি পরিচালিত হচ্ছে।

আগুন নিয়ে সমালোচনা :
গত ১ মার্চ শুক্রবার চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার এক্সেস রোডে নির্মাণাধীন হিমাগারে আগুন। এর ঠিক দু‘দিন পর ৪ মার্চ সোমবার বিকেলে কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যা এলাকায় চিনির গুদামে আগুন। দুটি অগ্নিকান্ডই ভয়াবহ। তবে তিন থেকে চার ঘণ্টা পর হিমাগারের আগুন নেভানো গেলেও চিনির গুদামের আগুন নেভেনি ৪৮ ঘন্টা পরও।

অগ্নিকান্ডের শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট অগ্নি নির্বাপণে কাজ শুরু করে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর ৭ ইউনিট ফেরত গেলেও এখনো আগুন নেভানোর কাজ করছে ৭টি ইউনিট। তারা আগুন পুরোপুরি নেভাতে ব্যবহার করছে অগ্নিনির্বাপক রোবট লুফ-৬০। যা চট্টগ্রামে সংঘটিত ভয়াবহ অগ্নিকান্ডগুলোর মধ্যে প্রথম।

এরপরও আগুন নেভাতে আরও ৪৮ ঘন্টা সময় লাগার কথা জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এস আলম গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানে পরপর বড় দুটি অগ্নিকান্ড দাগ কেটেছে চট্টগ্রামের মানুষের মনে। চিনির গুদামে অগ্নিকান্ডের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব হয়ে উঠে। যেখানে রোজা ঘিরে চিনির বাজার নিয়ে চলছে নানা সমালোচনা। এর মধ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের বক্তব্যকে সামনে নিয়ে আসছেন অনেকে।

তিনি বলেছেন, আগুনের ঘটনায় অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে দুই-একদিন চিনি নিয়ে কারসাজি করতে পারে। আমাদের কাছে সরবরাহ করার জন্য চিনির পর্যাপ্ত স্টক রয়েছে। দুই-একদিন পর আমাদের উৎপাদন শুরু হলে অসাধুদের খেলা পন্ড হয়ে যাবে।

এই বক্তব্যে প্রশ্ন উঠেছে, এই আগুন কী তাহলে কোন ষড়যন্ত্র, নাকি নাশকতা? নাকি ব্যাংক ঋণ থেকে রেহাই পাওয়ার কোন কৌশল বা কারসাজি। রটেছে আগুনে বীমাসুবিধা পাওয়ার কথাও। তবে সব সমালোচনাকে উড়িয়ে দিয়ে এস আলম গ্রুপের গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (জিমএম-করপোরেট) মোহাম্মদ আকতার হোসেন বলেন, এ জাতীয় প্রশ্নের দিকে আমরা এখন যেতে চাচ্ছি না। কেউ ষড়যন্ত্র করেছে কিনা, নাকি নাশকতা করেছে, সে ধরনের কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে এখন কথা বলতে চাই না। আর আমরা মানসিকভাবে সেরকম প্রস্তুতও নই এই মুহূর্তে। আপনারা সরেজমিনে আছেন, আমাদের কোনো লিকেজ আছে কিনা দেখুন?

আগুনের সূত্রপাত নিয়ে রহস্য :
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বিকেল ৪টার দিকে আগুন লাগার খবর পেয়ে শুরুতে দুটি ইউনিট, পরে আরও ৫ ইউনিটসহ মোট ৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তবু আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় যুক্ত হয় আরো ৭টি ইউনিট। সবমিলিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৪ টি ইউনিট কাজ করে।

পরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু কারখানার ভেতর দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। গুদামের ভেতরে ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আগুন জ্বলছে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঢুকতে পারছেন না। এ কারণে আগুনে ক্ষতির পরিমাণও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি আগুন কিভাবে লেগেছে তাও এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে অগ্নিকান্ডের সময় গুদাম বন্ধ থাকায় হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

এর আগে শুক্রবার বাকলিয়া এক্সেস রোডে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদের বড় ভাই শহীদুল আলমের তত্ত্ববধানে নির্মাণাধীন হিমাগারে আগুন লাগে। তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও বিকেল পেরিয়ে যায় পুরোপুরি নেভাতে। সেই অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত স¤পর্কেও এখনো জানা যায়নি।

তদন্ত কমিটি যা করলো :
এদিকে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে সোমবার রাতেই ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সার্বিক ও ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় কমিশনার আনোয়ার পাশা। মঙ্গলবার দুপুর দুইটা নাগাদ তাঁরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

আনোয়ার পাশা বলেন, বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এস আলম সুগার মিলে যতটুকু ফায়ার সেফটি প্রয়োজন ততটুকু ছিল না। ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে এখনো জ্বলছে আগুন। তাপমাত্রা ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। ভেতরে প্রবেশের কোন জোঁ নেই। বাইরে থেকে ফায়ার এক্সিটিংগুইসার বল আর পানি নিক্ষেপ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চলছে।

গোডাউনের ভেতরে থাকা অপরিশোধিত চিনি পুড়ে ছড়িয়ে যাওয়া আঠালো আস্তরণ আর তাপ ভোগাচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। চিনির কাঁচামালগুলো দাহ্য পদার্থ। এসব না সরানো পর্যন্ত আগুন জ্বলতে থাকবে। আগুন পুরোপুরি নেভাতে অগ্নিনির্বাপক রোবট লুফ-৬০ ব্যবহার করা হচ্ছে। আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ করতে আরও দুই দিন লেগে যেতে পারে।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page