শুক্রবার- ১৪ মার্চ, ২০২৫

জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রামে ব্যাপক ক্ষতি

print news

টানা ৬ দিনের বৃষ্টি ও জোয়ারে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রাম মহানগরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার সড়কসহ নানা অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে নগরীর একাধিক সড়ক-নালা ও খাল। শুধুমাত্র খাতুনগঞ্জে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার পণ্য। ক্ষতির মুখে পড়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পও।

বৃষ্টির প্রবণতা কমার সাথে জোয়ারের প্রবণতাও কমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম মহানগরসহ ডুবে যাওয়া জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে পানি নামার পর বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) সকাল থেকে এই ক্ষতি দৃশ্যমান হয়েছে। ক্ষতি নিরপণে কাজ করছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এমন তথ্য জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মো. খাইরুজ্জামান।

তিনি বলেন, গত ৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টির সাথে বঙ্গোপসাগরের প্রবল জোয়ারে পানিতে চট্টগ্রামে সবকটি নদি ভরে যায়। এর মধ্যে পাহাড় থেকে নেমে আসা বৃষ্টির তোড়ে চট্টগ্রাম মহানগর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবকটি উপজেলা পানির নিচে তলিয়ে যায়। এতে মানুষের দুর্ভোগ শুরু হয়। দেখা দেয় খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট। তবে গত মঙ্গলবার থেকে জেলা প্রশাসেনর পক্ষ থেকে খাদ্য ও সুপেয় পানির বিতরণসহ ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করে। যা এখনো অব্যহত রয়েছে।

তিনি বলেন, গত বুধবার বিকেল থেকে বৃষ্টি ও জোয়ারের প্রবণতা কমায় নগরের সৃষ্ট জলাবদ্ধতা অনেকটা হ্রাস পায়। এতে নগরীর সড়ক, নালা ও খালের ব্যাপক ক্ষতি দৃশ্যমান হতে থাকে। এর মধ্যে নগরীর মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট মোড় পর্যন্ত সড়কটির অবস্থা বেহাল হয়ে পড়েছে। এ সড়কে অসংখ্য বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় যানচলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এছাড়া আন্দরকিল্লা থেকে বহদ্দারহাট মোড় সড়কে বেশ কিছু খানা-খন্দ সৃষ্টি হয়েছে।

এছাড়া বহদ্দারহাট থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা সড়কটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। প্রতিদিন লাখ লাখ যাত্রী এই গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দিয়ে চলাচল করে। সড়কটিতে এখন যা অবস্থা, বাস কিংবা অন্যান্য গণপরিবহনে চড়ার পর মনে হবে যেন গরুর গাড়িতে চড়েছেন। সড়কটিতে পাঁচ শতাধিক ছোট বড় গর্ত রয়েছে। খানাখন্দের সাথে কর্দমাক্ত রাস্তা যাত্রী সাধারণকে দারুণ দুর্ভোগে ফেলেছে। পরিবহনে চড়তে গিয়ে যাত্রীদের বড় ধরণের ঝাঁকুনি খেতে হচ্ছে। এছাড়া এই সড়কে ছোট বড় বিভিন্ন ধরণের যানবাহন চলছে অত্যন্ত মন্থর গতিতে। এরমধ্যে গর্তে কোনো গাড়ি আটকে গেলে দ্রুত লম্বা লাইনের যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।

এ দুর্ভোগ আরো বেশি হচ্ছে যেসব যাত্রী কালুরঘাট কিংবা কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে বহদ্দারহাট প্রবেশ করছে তাঁদের জন্য। বহদ্দারহাট মোড় থেকে ছাড়ার সময় মূল সড়ক ব্যবহার করলেও বহদ্দারহাটমুখী যানবাহনগুলো সেখানকার টার্মিনালের অভ্যন্তরীণ সড়ক দিয়ে ঘুরে শাহ আমানত সেতু সংযোগ (নতুন চান্দগাঁও থানার সামনে) ধরে গন্তব্যস্থলে আসতে হচ্ছে।

এতে সবচেয়ে বেশি বিপত্তি ঘটছে টার্মিনাল এলাকাটিতে। এখানে ইট বিছানো এবড়ো থেবড়ো ও খানাখন্দে ভরা রাস্তা ও সিটি পরিবহনসহ আন্তঃজেলার বিভিন্ন যানবাহনের উপস্থিতি দীর্ঘ সময় ধরে যানজট পরিস্থিতিতে ফেলছে। সড়কটিতে সিটি করপোরেশনের একদল কর্মী ইট দিয়ে কিছু অংশের গর্ত ভরাট করার কারণে সড়কটি আরো এবড়ো থেবড়ো হয়ে গেছে।

এছাড়া নগরীর লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সড়কটিতেও বিভিন্ন জায়গায় ছোট বড় গর্ত রয়েছে। এছাড়া মদুনাঘাট, জিইসি মোড়, শেখ মুজিব রোড, আগ্রাবাদ, বারিক বিল্ডিং, বিশ্বরোড, বন্দর রোড, ফ্রি পোর্ট, পোর্ট কানেক্টিং রোড, হালিশহর, বড়পোল, ডিটি রোড, ফইল্যাতলী বাজার, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড ও খুলশী সড়কসহ সব ব্যস্ততম সড়ক ছোট বড় খানাখন্দে ভরে গেছে।

Ctg Flood before 10.08 1

এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা যায় আগ্রাবাদ এক্সেস সড়ক ও পোর্ট কানেক্টিং সড়ক। আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কটিতে যানবাহন চলাচল কঠিন হয়ে পড়েছে। এই সড়ক দিয়ে বিভিন্ন ধরণের যানবাহন অত্যন্ত মন্থর গতিতে চলাচল করছে। বৃষ্টির সাথে জলাবদ্ধতা এই সড়কটির জন্য হয়ে উঠেছে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। অন্যদিকে পোর্ট কানেক্টিং সড়কটিতে নিয়মিত ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে সড়কটি আরো করুণ দশায় পরিণত হচ্ছে। আবার এসব সড়কের পাশের নালা ও খালের অধিবাংশ স্থান বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। এই সব দেখার দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সাধারণ স¤পাদক নজরুল ইসলাম খোকন বলেন, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট দিয়ে চললে বিভিন্ন যানবাহনের ইঞ্জিন, চেসিস, এঙ্গেলসহ বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রাংশ নষ্ট ও ভেঙে যায়। গ্যারেজে নিলে সেখানে মালিকদের হাজার হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ গুণতে হচ্ছে। এছাড়া ভাঙাচোরা রাস্তাঘাটের কারণে বিভিন্ন সময় যানজটে পড়ে জ্বালানি ব্যয় বাড়ছে।

এ বিষয়ে কথা হলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রাম মহানগরী কিছু এলাকার সড়কে গর্ত তৈরি হয়েছে। কিছু এলাকায় দেয়াল ধস হয়েছে। ফুটপাত ও ড্রেনের ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষতি নিরূপণের জন্য রোববার একটি টিম গঠন করে অফিস অর্ডার করা হয়েছে। সোমবার ওই টিমকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। রিপোর্ট পেলেই ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও ফুটপাত মেরামতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

প্রশ্নের জবাবে চসিকের এই কর্মকর্তা বলেন, অনেকেই মনে করেন, নগরীর সবগুলো রাস্তা মেরামতের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। আসলে তা না। যেমন সিডিএ কর্তৃক যে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে, সেখানকার পাশ্ববর্তী ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো মেরামতের দায়িত্ব সিডিএর। সড়ক ও জনপদের সড়কও রয়েছে নগরে।

খাতুনগঞ্জের ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা :
অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে জলাবদ্ধতার চিত্র পুরোনো। এবারও দেশের বড় পাইকারি এ বাণিজ্য কেন্দ্রে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ ও কোরবানীগঞ্জে ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সরাসরি এই ক্ষতি হয়েছে পাঁচ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।

খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সগীর আহমদ বলেন, আর্থিক ক্ষতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে পাঁচ ধরনের হিসাব বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো জলাবদ্ধতার সময় পণ্যের ক্ষতির পরিমাণ, অবকাঠামো ও স¤পদের ক্ষতি, অবকাঠামো খাতে বাড়তি বিনিয়োগ, পরিবহনসেবা ও শ্রম খাতে কর্মঘণ্টা নষ্ট এবং বাড়তি পরিচালন ব্যয়। এতে পরোক্ষ ক্ষতির আর্থিক মূল্য বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

চট্টগ্রামের গবেষক এ কে এম নজরুল ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতার প্রভাবে খাতুনগঞ্জে প্রতিবছর ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। এখানবার শতভাগ প্রতিষ্ঠানই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দোকান বা গুদামে পানি ঢুকে পণ্য নষ্ট হচ্ছে। আবার কম দামেও পণ্য বিক্রি করতে হয়। ব্যবসায়ীদের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতির বিষয়টিও এখানে রয়েছে। এখান থেকে সারা দেশে পণ্য যায়। তাতে এর প্রভাব কার্যত সারা দেশে পণ্যের দামেও পড়ছে।

তিনি বলেন, দিনে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলেই চাক্তাই খালসহ আশপাশের খালে পানির উচ্চতা ৪ দশমিক ১ মিটার বেড়ে যায়। এতে প্রধান সড়কে ১ মিটারের উঁচু পানি জমে যায়। জোয়ার হলে তা আরও বাড়ে। সে জায়গায় এবার ৬৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে আবহাওয়া অফিসের তথ্যে জানা গেছে। এ থেকে খাতুনগঞ্জের ক্ষতি সহজেই অনুমেয়।

ক্ষতির মুখে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প :
টানা ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পার্বত্য তিন জেলা বন্যার কবলে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতির মুখে পড়েছে উন্নয়ন প্রকল্পও। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক স্থানে রেললাইন ভেঙে গেছে, কোথাও রেললাইনের পাথর সরে গেছে, সেতু ধসে গেছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি।

পটিয়া রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিন বলেন, টানা বর্ষণে নির্মাণাধীন এই রেলপথের পটিয়া শ্রীমাই খালের ওপরের সেতুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেতুটির রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে গেছে। বিষয়টি কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। রেলওয়ের যান্ত্রিক বিভাগ এটির দেখার দায়িত্বে রয়েছে।

দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, টানা বর্ষণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে রেললাইনের ক্ষতি হয়েছে। তবে কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে তা পানি কমার পর জানা যাবে। পানি এখনো রেললাইনের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন ৯০ কিলোমিটার দৃশ্যমান। প্রকল্পের কাজ ৮৭% স¤পন্ন হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে রেললাইনের কাজ স¤পন্ন করে ট্রেন চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। গত কয়েক দিন বন্যার কারণে রেললাইনের কাজ করা যায়নি। পানি নেমে যাওয়ার পর যেসব স্থানে সমস্যা হয়েছে তা ঠিক করা হবে।

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page