
করোনা মহামারী থেকে শুরু করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গিয়েছিল পণ্যের দাম। এর প্রধান একটি কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা দেখিয়েছিলেন আমদানি পণ্যের পরিবহনে খরচ বৃদ্ধি। তবে গত কয়েক মাসের পরিসংখ্যান বলছে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এর পরিবর্তন এসেছে। ভোক্তা পর্যায়ে কমেছে ভোগের পরিমাণ।
ফলে চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানিকারক দেশ থেকে পণ্য বুকিং কমতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রতিযোগিতা মূল্যে ভাড়া প্রস্তাব করছেন জাহাজ মালিকরা। যার ফলে কমে এসেছে পণ্য পরিবহনের খরচ। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ভোক্তারা এর সুফল পাননি এখনো।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সমিতির সাধারণ স¤পাদক মোহাম্মাদ মহিউদ্দিন। বৃহস্পতিবার (০১ জুন) দুপুরে এ বিষয়ে আলাপকালে তিনি বলেন, ডলার সংকটের পাশাপাশি এলসি জটিলতায় আমদানি কমেছে। এতে জাহাজের পণ্য পরিবহন কমায় ভাড়াও কমেছে। কিন্তু ভাড়া কমলেও আমরা এর সুফল পাচ্ছি না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে তেল-চিনি-মসলা থেকে শুরু করে অধিকাংশ ভোগ্যপণ্য জাহাজ দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। সে হিসেবে জাহাজ ভাড়া বাড়ার অজুহাতে গত দুই বছরে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম দু-তিন গুণ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখন জাহাজ ভাড়া কমলেও দেশের বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
তিনি বলেন, ২০২০ থেকে ২০২২ সালে প্রতি মণ সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৩ হাজার ৭০০ টাকা ও চিনির দাম ছিল ২ হাজার ৬০০ টাকা। যার দাম বাড়তে বাড়তে বর্তমানে মণপ্রতি সয়াবিন তেলের দাম ৬ হাজার ৭০০ টাকা ও চিনির দাম ৪ হাজার ৬০০ টাকায় ঠেকেছে।
তবে কিছুটা ব্যতিক্রম কথা বলেছেন ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম যেমন কমেছে জাহাজ ভাড়াও কমেছে। কিন্তু দেশে ডলারের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। প্রতি ডলারের বিপরীতে আমদানীকৃত পণ্যে আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক রুটে পণ্য পরিবহনে খরচ কমলেও সেই সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা।
একই চিত্র রফতানি খাতের প্রধান উপকরণ গার্মেন্টস শিল্পেও। বৈশ্বিক মন্দার ফলে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ জাহাজ ভাড়া কমার সুযোগ পাচ্ছে না বলে দাবি করেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী।
তিনি বলেন, ক্রয়াদেশ না থাকায় আমাদের রফতানি কমে গেছে। একই সঙ্গে আমদানিও কমে গেছে। এর জন্য বাধ্য হয়ে জাহাজ ভাড়া ও কনটেইনার ভাড়া কমিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্বখ্যাত ১২ থেকে ১৫টি শিপিং লাইন বাংলাদেশে পণ্য পরিবহন করছে। তবে কাক্সিক্ষত পণ্য না পাওয়ায় কিছু কিছু শিপিং লাইন তাদের জাহাজের পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. আরিফ বলেন, বৈশ্বিক কারণে বাংলাদেশে আগে যেভাবে জাহাজে করে পণ্য আসত, এখন সব পণ্য আসছে না। কারণ, আমাদের এলসি (ঋণপত্র) সমস্যা ও ডলার সংকট রয়েছে।
তিনি বলেন, গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমানে পণ্য পরিবহনের ভাড়া অর্ধেক কিংবা তারও নিচে নেমে এসেছে। সমুদ্রপথে রফতানির প্রধান দুই রুট চট্টগ্রাম থেকে ইউরোপ এবং চট্টগ্রাম থেকে যুক্তরাষ্ট্র দুই ক্ষেত্রেই জাহাজ ভাড়া কমেছে অর্ধেক। আর কনটেইনারে শিল্পপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রধান রফতানিকারক দেশ চীন থেকে চট্টগ্রাম রুটে জাহাজ ভাড়া কমেছে অর্ধেকেরও বেশি।
শিপিং এজেন্টদের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্রগামী ৪০ ফুট হাইকিউব প্রতিটি কনটেইনারের ভাড়া ১৬-১৮ হাজার মার্কিন ডলার হলেও এখন তা কমে মাত্র ৭-৮ হাজার বা তারও কম মার্কিন ডলারে এসে থেমেছে। একইভাবে ইউরোপগামী কনটেইনারের ভাড়া ১৬ হাজার মার্কিন ডলার থেকে কমে নেমেছে মাত্র ৬-৭ হাজার মার্কিন ডলারে।
আর চীন থেকে কনটেইনার পরিবহনের খরচ কমেছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে। গত বছর চীন থেকে কনটেইনারে পণ্য আনতে ৮-১০ হাজার ডলার পরিশোধ করতে হতো দেশের আমদানিকারক ও শিল্পোদ্যোক্তাদের। সে খরচ কমে আড়াই থেকে তিন হাজার ডলারে নেমে এসেছে। ইউরোপ-আমেরিকায় সরাসরি জাহাজ চলাচল ছাড়াও সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া এবং শ্রীলঙ্কাকে ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট হিসেবে ব্যবহার করে পণ্য আনানেয়া করে বাংলাদেশ। আগে এসব ফিডার ভ্যাসেলে কনটেইনার ভাড়া ৫০০ মার্কিন ডলার হলেও এখন ২০০ থেকে ৩০০ ডলারে পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ১৫০টিরও বেশি দেশ থেকে পণ্য সমুদ্রপথে বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। এ পথে সবচেয়ে বেশি পণ্য আসে চীন থেকে। বাংলাদেশের জন্য বড় রফতানিকারক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত চীন থেকে সমুদ্রপথে জাহাজে পণ্য আসে মূলত দক্ষিণ চীন সাগর, মালাক্কা প্রণালি ও আন্দামান সাগর হয়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে। দেশটি থেকে যেসব পণ্য আমদানি হয় তার বড় অংশ সাধারণ মানুষের ব্যবহারের পণ্য। এছাড়া সরকারের অনেক প্রকল্পের যন্ত্রপাতিসহ মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রেও দেশটির ওপর নির্ভরতা রয়েছে।
ভাড়া কমে যাওয়ার বিষয়ে সাইফ মেরিটাইম লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার মো. আব্দুল্লাহ জহির বলেন, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় পণ্য পরিবহন চাপ কমতে শুরু করেছে। ফলে জাহাজ ভাড়া কমে আসছে। করোনা যখন শুরু হয় চীন সে সময়কালে কনটেইনার লিজ আর জাহাজের চার্টার রিনিউ করেনি। ফলে রফতানির চাপ যখন বাড়তে শুরু করে তখন চাহিদার বিপরীতে কনটেইনারের বড় সংকট তৈরি হয়ে জাহাজ ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। মহামারীর ১৮ মাস পর বৈশ্বিক পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় জট লেগে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে জাহাজ জট এবং খালি কনটেইনারের ঘাটতির কারণে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ভাড়া (ফ্রেইট চার্জ) বেড়ে গিয়েছিল। বর্তমানে জাহাজ ভাড়া কমতে থাকার মূল কারণ বৈশ্বিক ভোগ কমে আসা। এতে আন্তর্জাতিক ক্রেতা দেশগুলো থেকে পণ্যের বুকিং কমে গিয়েছে।
দেশের শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, একটা সময় চট্টগ্রাম বন্দরের নামের সঙ্গে কনটেইনার ও জাহাজ জট সমার্থক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় ধীর হয়ে আসায় বন্দরে জাহাজের অবস্থান করার সময়ও কমে এসেছে। এখন কোনো রকম জট ছাড়াই কনটেইনার খালাসে গতি এসেছে। তবে জাহাজ ভাড়া কমে যাওয়ায় পণ্য আমদানিতে ব্যয় কমার যৌক্তিক কারণ থাকলেও ডলারের বিনিময় মূল্য হারের অস্থিরতার কারণে সে সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা।
চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহণ) এনামুল করিম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই দেশের ৯২ শতাংশ পণ্য আমদানি হয়ে থাকে আর রফতানি বাণিজ্যের ৯৮ শতাংশই স¤পন্ন হয় এ বন্দর দিয়েই। তাই জাহাজ এবং কনটেইনার পরিবহন ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। বছরে এখানে যেমন ৪ হাজারের বেশি জাহাজ আসছে, তেমনি কনটেইনার ওঠানামা করছে ৩২ লাখেরও বেশি। সাধারণত জাহাজ কিংবা কনটেইনারের ভাড়া বাড়লে এখানের পণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমানে জাহাজ ও কনটেইনার ভাড়া তুলনামূলক কম হলেও পণ্যের দাম কমছে না।