
রাষ্ট্রায়ত্ত জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) হাতে বর্তমানে জাহাজের সংখ্যা মাত্র ৭টি। যা দিয়ে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে হাতছাড়া হচ্ছে অন্তত ৫০০ কোটি ডলারেরও বেশি।
এই বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়ার জন্য হাতে থাকা ৭টিসহ মোট ২৭টি জাহাজের একটি বহর গড়ে তোলতে চাই বিএসসি। এ লক্ষ্যে আগামী বছর দুয়েকের মধ্যে ৪টি এবং ২০৩০ সালের মধ্যে আরো ১৬টি নতুন জাহাজ কিনতে কার্যক্রম চালাচ্ছে বিএসসি।
মঙ্গলবার (১৩ জুন) এ তথ্য জানান বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) ক্যাপ্টেন মো. মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, সমুদ্রে পরিবহণ বাণিজ্যে শুধুমাত্র বাংলাদেশি আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনের বাজার প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের। যার প্রায় পুরোটাই বিদেশি জাহাজ মালিকদের পকেটে চলে যায়। দেশের এই আমদানি-রফতানি বাণিজ্য আরও বড় হচ্ছে দিন দিন। তাই সমূদ্র বাণিজ্যে আমদানি-রফতানি কাজে অংশ গ্রহণ করে বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের জন্য নতুন আরো ২০টি জাহাজ কিনতে চাই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি।
এর মধ্যে প্রথমে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার দুটি মাদার ট্যাংকার ও ৮০ হাজার টন ধারণক্ষমতার দুটি বাল্ক ক্যারিয়ার চীন থেকে জিটুজি ভিত্তিতে কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হচ্ছে। যার জন্য ব্যয় হবে ২ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। আর এর প্রায় সব টাকাই ঋণ সহায়তা দিবে চীনের এক্সিম ব্যাংক। সব ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে চারটি জাহাজ বিএসসির বহরে যুক্ত হবে।
বাকি ১৬টি জাহাজের মধ্যে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টিউস ধারণ ক্ষমতার ছয়টি কন্টেইনার জাহাজ কেনার জন্য অস্ট্রেলিয়ার এআইএস মেরিন অ্যান্ড অফশোর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বিএসসি। এর আগে প্রতিষ্ঠানটির শিপ রিপেয়ার অ্যান্ড নিউবিল্ড ডিভিশন থেকে বিএসসির কাছে টেকনিক্যাল আউটলাইনসহ জাহাজ সরবরাহের একটি প্রস্তাবনা পাঠায়।
আবার একই ধরনের ছয়টি সেলুলার কন্টেইনার জাহাজ কেনার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার ডায়সান শিপবিল্ডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কো¤পানি লিমিটেডের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে বিএসসি। এর আগে ছয়টি কন্টেইনার জাহাজ সরবরাহের জন্য ইচ্ছা পোষণ করে গত সম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বরাবর আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট সো কিউন লি। চিঠিতে জিটুজি ভিত্তিতে বিএসসিকে ছয়টি কন্টেইনার জাহাজ সরবরাহের আগ্রহের কথা জানানো হয়। পরে প্রতিষ্ঠান দুটির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে বিএসসি। বিদ্যমান জাহাজগুলোর সাথে নতুন জাহাজগুলো যুক্ত হলে ক্রমে ঘুরে দাঁড়ানো বিএসসি দেশের সমুদ্র বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
বিএসসির নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্য) ড. পিযুষ দত্ত বলেন, বিশ্বের নানা দেশ থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করে। একই সাথে রফতানি করা হয় ৩০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। দেশের আমদানিকৃত পণ্যের অন্তত ৮২ শতাংশ পরিবাহিত হয় সমুদ্র পথে। রফতানি পণ্যের প্রায় পুরোটাই পরিবাহিত হয় জাহাজের মাধ্যমে। এক বছরের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের যে পণ্য সমুদ্র পথে পরিবাহিত হয় তাতে ব্যয় হয় অন্তত ৫০০ কোটি ডলার। এই টাকার প্রায় পুরোটা বিদেশি জাহাজ মালিকদের পকেটে চলে যায়। বিশাল এই বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব নগণ্য।
তিনি বলেন, বিএসসি কিংবা দেশীয় বেসরকারি কো¤পানিগুলোর কাছে পর্যাপ্ত জাহাজ না থাকায় বাংলাদেশ সমুদ্র বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। বর্তমানে দেশে মাত্র ৭টি কন্টেইনার জাহাজ রয়েছে। খোলা পণ্যবাহী জাহাজ (লাইটার) রয়েছে ৮৪টির মতো। সরকার ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন আইনের মাধ্যমে দেশীয় জাহাজ শিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা করলেও পর্যাপ্ত জাহাজের অভাবে তা ব্যাহত হচ্ছে। দেশীয় জাহাজ না থাকায় পরিবহন ব্যয়ের কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রায় বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। সরকারি সংস্থা বিএসসি কিংবা দেশীয় বেসরকারি কো¤পানিগুলোর বহরে জাহাজের সংখ্যা বাড়ানো গেলে এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব বাড়ত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তিনি আরও বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) নিজস্ব সময়সূচি অনুযায়ী মাদার ট্যাংকারে জ্বালানি পরিবহন করা হবে। আমদানি করা ক্রুড অয়েল সরাসরি আনলোড করার জন্য বঙ্গোপসাগরে মহেশখালীর পশ্চিম প্রান্তে ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরি নামের একটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ফলে যে দুটি মাদার ট্যাংকার কেনা হচ্ছে, সেসব জাহাজ বঙ্গোপসাগরে ভিড়িয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে হতে ক্রুড অয়েল ও রিফাইন্ড প্রোডাক্ট সরাসরি ইস্টার্ন রিফাইনারির ডিপোতে স্থানান্তর করা সম্ভব হবে।
একইসাথে রামপাল, মাতারবাড়ি ও পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ দেশে প্রচুর কয়লা আমদানি হবে। এছাড়া চট্টগ্রামে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক জোন এবং আনোয়ারায় চায়না ইকোনমিক জোনের কার্যক্রম শুরু হবে। এতে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য দ্রুত বাড়বে। আমদানি-রফতানি যাতে দেশীয় জাহাজ পরিবহন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে বিএসসি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন জাহাজ কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী জাহাজ কেনা সম্পন্ন হলে বিএসসির জাহাজের বহর সমৃদ্ধ হবে। সাশ্রয় হবে প্রচুর ডলার। পাশাপাশি বিএসসির আয় বাড়বে। এছাড়া নাবিকদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়ে দেশীয় নাবিকদের চাহিদা বাড়বে বলেও আশাবাদ প্রকাশ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
সূত্রমতে, ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিএসসির বহরে ৪৪টি জাহাজ ছিল। পরে বয়সজনিত কারণ ও নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির কারণে বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক হওয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ে ৩৬টি জাহাজ বিক্রি করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় বিএসসি অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়ে।
১৮টি জাহাজ কেনার মাধ্যমে ১৯৮০ সালের দিকে সংস্থাটির বহরে জাহাজের সংখ্যা দাড়ায় ২৬টিতে। পরে তা এসে ঠেকে মাত্র ২টিতে। বেহাল এই অবস্থায় ২০১৮ সালে বিএসসি চীন থেকে ৬টি নতুন জাহাজ কিনে। এর মধ্যে একটি ইউক্রেনে গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে বিএসসির বহরে আগের দুটিসহ মোট ৭টি জাহাজ আছে। যা দিয়ে ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে অংশ নেয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়। ফলে হাতছাড়া হচ্ছে বিপুল বৈদৈশিক মূদ্রা।
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মো, জিয়াউল হক বলেন, দেশের বর্তমান আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনে সমুদ্রগামী জাহাজ ভাড়া বাবদ প্রচুর অর্থ বিদেশি জাহাজ মালিকরা নিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ পরিবহন ব্যয় অদূর ভবিষ্যতে আরও বাড়বে, কেননা দেশের অর্থনৈতিক আকারও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।
তিনি বলেন, বিএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় এ প্রতিষ্ঠানে দেশের বর্তমান চাহিদা বিবেচনায় আরও ৪০-৫০টি জাহাজ থাকা উচিত। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূল কারণে বিশেষ করে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে না পারায় সে পরিমাণ জাহাজ কর্পোরেশনের বহরে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে সরকারের দিকনির্দেশনা ও সক্রিয় সহযোগিতায় এ সংস্থা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিএসসিকে বিশ্বমানের একটি স্বয়ংস¤পূর্ণ আন্তর্জাতিক শিপিং সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।