বৃহস্পতিবার- ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫

টেন্ডারই হয়নি, অথচ কেনাকাটার ভুয়া বিলে কোটি টাকা লোপাট!

নেপথ্যে কারা-তদন্তে কমিটি

ভুয়া বিল-ভাউচারে পূর্ব রেলের কোটি টাকা হাওয়া
print news

চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে অবস্থিত রেলের বিভাগীয় প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে পণ্য কেনার টেন্ডারই হয়নি। বিল পরিশোধ করতে পাঠানো হয়নি কোনো চিঠিও। অথচ বিল-ভাউচার দেখিয়ে ৯৭ লাখ টাকা নিয়ে গেছে এক ঠিকাদার। যা কারসাজির ভুয়া বিল-ভাউচারে হয়েছে।

মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে এ তথ্য জানান রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তা (পূর্ব) সাইদুর রহমান সরকার। তিনি বলেন, ভুয়া বিলের বিপরীতে টাকা নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ সাতজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বিষয়টি নজরে আসার বিষয়ে তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবার বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। এরপর রোববার রেলের এডিজি মহোদয় চট্টগ্রামে আসেন। এরপর বিষয়টি জানাজানি হয় রেল অঙ্গনে। এ নিয়ে এখন তোলপাড় চলছে রেলওয়ের সর্বমহলের মাঝে।

তিনি আরও বলেন, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার জন্ম দিয়েছে নাবিল আহসান চৌধুরীর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান (সাপ্লাইয়ার) দ্যা কসমোপলিটন কর্পোরেশন। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে রেলওয়ের সাত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়েছে। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

সাত কর্মকর্তা ও কর্মচারী হলেন- হিসাব কর্মকর্তা মামুন হোসেন, হিসাবরক্ষক শিমুল বেগম, অডিটর (ডিএফএ) পবন কুমার পালিত, হিসাব কর্মকর্তা (প্রশাসন) মো. আবু নাছের, হিসাবরক্ষক (প্রশাসন ও সংস্থাপন) সৈয়দ সাইফুর রহমান, জুনিয়র অডিটর ইকবাল মো. রেজাউল করিম এবং অফিস সহায়ক মাকসুদুর রহমান।

এছাড়া চট্টগ্রামের বিভাগীয় হিসাব কর্মকর্তা (ডিএফএ) জয়শ্রী মজুমদারকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি। আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি থানায় জিডি করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (জিএম) নাজমুল ইসলাম বলেন, অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় কয়েকজনকে বদলি ও সাময়িক বরখাস্তের বিষয়ে আমাকে জানানো হয়েছে। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পূর্বাঞ্চলের অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তার দপ্তর (এফএঅ্যান্ডসিএও) কে বলা হয়েছে।

সূত্র মতে, ভুয়া বিলে প্রায় কোটি টাকা হাওয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা রেলের ইতিহাসে প্রথম নয়। এর আগেও ভুয়া বিল দেখিয়ে ৯৮ লাখ টাকা হাওয়া হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে পরে এই টাকা ফেরত দিয়ে বিষয়টির সুরাহা করা হয়।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

সংশ্লিষ্টরা জানান, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান (সাপ্লাইয়ার) দ্যা কসমোপলিটন কর্পোরেশন ৩ কোটি ৬২ লাখ ৬১ হাজার টাকার কাজের বিল পায়। তাদের গত ১৮ ডিসেম্বর ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, ১৯ ডিসেম্বর ৯০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা এবং ২০ ডিসেম্বর ৯৬ লাখ ৯০ হাজার ও ৭৭ লাখ ৫২ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়। চেকগুলো নগদায়ন করা হয় ২১ ডিসেম্বর।

এসব চেকের নম্বর ছিল যথাক্রমে আরএ-১১৩৯৩০৪, ১১৩৯৩০৬, ১১৩৯৩০৫ এবং ১১৩৯৩০৭। কিন্তু আরএ-১১৩৯০৮৫ নম্বরের আরেক চেক দিয়ে গত ৩১ ডিসেম্বর ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকার একটি বিল আগ্রাবাদের সীমান্ত ব্যাংক থেকে নগদায়ন করা হয়। বিলটি উত্তোলন করেন সোহাগ আলী নামের এক ব্যক্তি। এই বিলটি নগদায়ন করার জন্য ওই ব্রাঞ্চে কসমোপলিটনের নামের একটি নতুন অ্যাকাউন্টও খোলা হয়। যেটিতে শুধুমাত্র ওই পঞ্চম চেকটি নগদায়ন করা হয়।

এদিকে দেখা গেছে, গত ৩১ ডিসেম্বর উত্তোলন করা চেকের নম্বরটি আগে দেওয়া বিলের চারটি চেকেরও আগের সিরিয়ালের। অথচ চেকের নম্বরের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী চারটি চেকের পরের সিরিয়াল অনুযায়ী হওয়ার কথা পঞ্চম চেকটি। এছাড়া পঞ্চম চেকের বিষয়টি রেলের খাতায় রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ নেই, এমনকি প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পূর্ব) দপ্তর থেকেও কোনো বিলের কপি ডিভিশনাল ফাইন্যান্স অফিসে (ডিএফও) ফরোয়ার্ড করা হয়নি। ঘটনাটি জানাজানি হলে গত ১১ ফেব্রুয়ারি রেল কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক বরাবরে ওই পঞ্চম চেকটি ফেরত চেয়ে চিঠি ইস্যু করে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভুয়া বিল দাখিল করে জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ঠিকাদারের সঙ্গে হিসাব ও স্টোরস শাখার একটি চক্র কাজ করেছে। অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তা মো. রফিকুল বারী খানের ব্যক্তিগত সহকারী আসিফ এবং ওই অফিসের অস্থায়ী কর্মচারী হাবিব এই কারসাজিতে জড়িত।

হাবিব রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক এক এফএঅ্যান্ডসিএওর ভাগিনা। সেই সুবাদে অস্থায়ী কর্মচারী হলেও তার কাছে অফিসের গোপন পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। গত বৃহ¯পতিবার টাকা উধাও হওয়ার ঘটনা প্রকাশের পর হাবিব আত্নগোপনে চলে যায়।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোন কথা বলতে রাজি হননি মো. রফিকুল বারী খান। তিনি বলেন, ঘটনার তদন্ত চলমান রয়েছে। এ অবস্থায় কোনরকম কথা বলা ঠিক হবে না। তবে তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রেলওয়ের তথ্যমতে, রেলের সব ধরণের কেনাকাটা প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের (সিসিএস) দপ্তরের মাধ্যমে করতে হয়। সব বিভাগ তাদের চাহিদা পাঠানোর পর পণ্য ক্রয় করে স্টোরে জমা রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে আহ্বানকৃত টেন্ডারের বিপরীতে বিল পাঠানো হয় বিভাগীয় হিসাব কর্মকর্তার দপ্তরে। সেখান থেকে প্রধান অর্থ ও হিসাব কর্মকর্তার দপ্তরে পাঠানো হয়। সেখানে সব ধরনের যাচাই-বাছাই শেষে এফএঅ্যান্ডসিএও অনুমোদনের পর চেক ইস্যু করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে-ঠিকাদাররা বিল উত্তোলন করতে গেলে স্টোরস শাখা ও হিসাব শাখার একাধিক টেবিলে টাকা দিতে হয়। যে ঠিকাদার যতবেশি টাকা দেন তার বিল তত দ্রুত এগিয়ে যায়। কসমোপলিটন কর্পোরেশনের মালিক নাবিল কর্মচারীদের চাহিদার চেয়েও বেশি ঘুষ দিতেন। ফলে তার বিল প্রদানের কাজ চলত দ্রুত গতিতে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তার বিল যাচাই-বাছাইয়ে সময়ক্ষেপণ করায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেছেন তিনি। ফলে তার প্রতিষ্ঠানের বিল নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে চাইতেন না কেউ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দ্যা কসমোপলিটন কর্পোরেশনের স্বত্বাধিকারী নাবিল আহসান চৌধুরী বলেন, আমাকে কাজের টাকা বাবদ রেলওয়ে থেকে চারটি চেক দেওয়া হয়েছে। আমি সেই চেকগুলো নগদায়ন করেছি। এরপর হঠাৎ রেল কর্তৃপক্ষ আমার কাছ থেকে ৯৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা মূল্যের একটি চেক ফেরত চেয়ে চিঠি দেয়। সেখানে উল্লেখ আছে, সোহাগ আলী নামের এক ব্যক্তি চেকটি ৩১ ডিসেম্বর নগদায়ন করেছেন। কিন্তু আমার এখানে সোহাগ আলী নামে কোনো ব্যক্তি নেই। আর এই ধরনের বিল চেয়ে আমি কোনো চিঠিও রেলওয়ে বরাবরে দিইনি।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

পঞ্চম চেকের বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি আমিই রেলের নজরে আনি। এখন তারা আমাকেই বলির পাঁঠা বানাচ্ছে। আমার ঘাড়েই টাকা আÍসাতের দোষ চাপাতে চাইছে। তারা কিন্তু এর মধ্যে সাত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্তও করেছে। এদিকে সোহাগ আলী নামের ওই ব্যক্তির কাছে চেক হস্তান্তরের সময় আমার কাছ থেকে রেল কর্তৃপক্ষ কোনো অথরাইজেশন নেয়নি। নিয়ম অনুযায়ী চেক হস্তান্তরের সময় তার এনআইডি যাচাই করার পর আমার প্রতিষ্ঠানের নামে চেক তাকে দেওয়ার সময় আমার অথরানাজাইশন নিতে হবে। রেলের এফএঅ্যান্ডসিএও নিজে তাদের গাফেলতির কথা আমার কাছে স্বীকার করেছেন।

তিনি আরও বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করে টাকা আত্নসাৎ করা হয়েছে। ব্যাংক থেকেও আমার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি।

পঞ্চম চেকের বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিসিএস) ফরিদ আহমেদ বলেন, এই ধরনের কোনো বিল হিসাব শাখায় পাঠানো হয়নি। সরঞ্জাম শাখার বাজেট থেকে কিভাবে টাকা চলে গেছে এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা হিসাব বিভাগ দেখবে। আমাদের কিছু করার নেই, আমার দপ্তরের কেউ জড়িত নন।

এ বিষয়ে জানতে তদন্ত কমিটির প্রধান জয়শ্রী করের দপ্তরে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি ছুটিতে আছেন বলে জানান পাহাড়তলীর সহকারী হিসাব কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন। কমিটির অপর সদস্য জহিরুল হোসেন রোববার থেকে ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানান।

তিনি বলেন, কসমো পলিটনের চারটি বিল ছিল, সেখানে একটি বিলের বিপরীতে দুইবার অর্থ ছাড় নিয়ে গেছে। টাকা উদ্ধারে কাজ শুরু হয়েছে। তবে কসমো পলিটনের মালিক দাবি করেছেন বিলটি তারা দেননি। তার প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে জালিয়াতি করা হয়েছে। চেকটি কোন ব্যাংকে জমা হয়েছে এবং কাকে টাকা দেওয়া হয়েছে, সেই তথ্য চেয়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছি। পাশাপাশি টাকা ছাড়ের আগে ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানের মালিককে ফোন দেওয়া হয়েছিল কিনা সেই বিষয়টিও আমরা দেখছি। কসমো পলিটনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তার ধারণা বিল গ্রহণ, প্রক্রিয়ায় ডেসপাস শাখার কর্মচারীরা জড়িত থাকতে পারে।

ঈশান/খম/সুপ

আরও পড়ুন

No more posts to show