কয়েক দিন ধরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ। আবার পায়রা বন্দর বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবস্থাও একই। কারণ একটাই-কয়লা নেই। কয়লা আমদানি বন্ধ। আর আমদানি বন্ধ হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে ডলার সংকট।
হজ যাত্রীদের জন্য ডলার প্রয়োজন। অনেকেই প্রয়োজন অনুযায়ী ডলার পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার বেশি দূরে বাইরে থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। যারা বিদেশে পড়াশোনা করতে যাবেন, তাদের অনেকেই চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছেন না। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশে পড়াশোনার জন্য তাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
এসব বাস্তবতা বলে দেয়, দেশে ডলার সংকট রয়েছে। সংকট নিরসনে সরকার ইতিমধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করেছে। অপ্রয়োজনীয় পণ্য, বিলাসসামগ্রী আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কারণ একটাই-ডলার সাশ্রয়।
গত সোমবার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে রয়েছে ২৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। গত রোববার পর্যন্ত এই বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩০ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। আকু পেমেন্টের পর কমে যায় রিজার্ভ। এখন যে পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পদ্ধতি হলো, রিজার্ভ থেকে বিদেশে বন্ড, মুদ্রা, স্বর্ণে বিনিয়োগ, রফতানি উন্নয়ন তহবিল গঠন, বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কেনার সোনালি ব্যাংকের ধার, পায়রা বন্দরের চ্যানেল খননের কর্মসূচিতে দেওয়া অর্থ ও শ্রীলঙ্কাকে ধার দেওয়াসহ ৮২০ কোটি ডলার (৮.২ বিলিয়ন) বাদ দিতে হবে। এর ফলে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়াবে ২১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের বাকি আছে প্রায় দুই মাস। এই সময়ের মধ্যে কাক্সিক্ষত জায়গায় নিতে ২৮৫ কোটি ডলার ঘাটতি পূরণ করতে হবে।
জানা গেছে, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ব্যয় কিছুটা কমলেও, ডলারের সংকট কমছে না। বরং উল্টো বাড়ছে। আমদানি ব্যয় মেটাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে চলতি অর্থবছরে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। ইতিমধ্যে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স কমেছে।
সম্প্রতি আইএমএফের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে গেল। সফরকালে প্রতিনিধি দল সরকারের বিভিন্ন সংস্থাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে ঋণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত তারা বেঁধে দিয়েছে। বিশেষ করে আগামীতে কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকবে তাও পরামর্শ দিয়েছে। তবে আগামী জুনের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। এ ব্যাপারে আইএমএফের শর্ত হচ্ছে, অন্তত ২৪ বিলিয়ন ডলার রাখতে হবে।
এ ব্যাপারে সিপিডির রিসার্চ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ডলারের মান কমিয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ব্যয় কমানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ডলার সংকট কমেনি। বরং উল্টো বাড়ছে। গ্যাস কয়লা আমদানি ব্যাহত হওয়ার ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের উপক্রম হয়েছে। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় প্রয়োজন কিংবা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়বে। সামনে এসব সমস্যা আরও বাড়বে। এটি টাকার বিনিময় মূল্যকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি হবে।
বিশ্বব্যাংকের আবাসিক অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ বলেন, ডলার সংকট ঘনীভূত হচ্ছে না। ঘনীভূত আছে। ডলারের অভাবে যদি কাঁচামাল আমদানি কম হয় তা হলে এর প্রভাব পড়বে শিল্প কলকারখানায় উৎপাদনের ওপর। আর উৎপাদন যদি কমে যায় এর প্রভাব পড়বে সরাসরি কর্মসংস্থানের ওপর। সবচেয়ে বড় কথা-ডলার সংকট একটি ঘূর্ণায়মান সমস্যা।
চক্রাকারে সবখানেই এর কমবেশি প্রভাব পড়বে। যা শেষমেশ মূল্যস্ফীতিতে আঘাত করে। ডলার সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারি চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। এর পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় পণ্য রফতানিতে মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কম সুদে আর সহজ শর্তে ঋণ নিতে হবে। এখনও কঠিন শর্তে ঋণ নেওয়া হয় বিভিন্ন দেশ থেকে। যা ডলারের ওপর চাপ পড়ে।