বৃহস্পতিবার- ২৭ মার্চ, ২০২৫

তিন কারণে স্বপ্নভঙ্গ হতে পারে ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেনযাত্রা

print news

বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে সেপ্টেম্বরেই ঢাকা থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ট্রেনযাত্রার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও ওই মাসের কোনো নির্দিষ্ট তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। তবে ওই মাসের মধ্যেও ট্রেন প্রকৃতপক্ষে কক্সবাজার যেতে পারবে কি না এ নিয়ে সন্দিহান সচেতন মহল।

শুধু সচেতন মহল নয়, খোদ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যদিও প্রকাশ্যে এ নিয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি নন। আর এই সন্দেহের পেছনে তিনটি কারণকে বড় ফাঁদ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ফাঁদ হিসেবে দেখছেন কর্ণফুলী নদীর উপর অবস্থিত শত বছরের পূরণো জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু, এরপর দেখছেন ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল লাইনে ফৌজদারহাট বাইপাস রেলপথ, এরপর দেখছেন কোচ ও ইঞ্জিন সংকট। এছাড়া কক্সবাজার-দোহাজারী রেল লাইন প্রকল্পের কাজ এখনো ১৬ ভাগ বাকি। যা সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হবে কি না-তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তথ্যমতে, জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু দিয়ে বর্তমানে যেসব ট্রেন যায় সেগুলো ১১ দশমিক ৯৬ টন এক্সেল লোডবিশিষ্ট অর্থাৎ ছোট লোকোমোটিভ বা হালকা ওজনের কোচের। এই ট্রেনও চলে মাত্র ১০ কিলোমিটার গতিতে। কিন্তু কক্সবাজারে যেসব ট্রেন নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে সেসব ট্রেনের ইঞ্জিন ১৫ এক্সেল লোডের। যা চলাচল করা কোনোমতেই সম্ভব নয়।

তবুও জরাজীর্ণ সেতুটি দিয়ে ট্রেন নিয়ে যেতে বুয়েটের কাছে ২৫ এক্সেল লোডের উপযোগী নকশা চেয়েছিল রেলওয়ে। তারই ভিত্তিতে ২০২১ সালের অক্টোবরে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের পর্যবেক্ষক দল সেতু পরিদর্শন করে জানালিহাট অংশে আবৃত প্রাচীর এবং সুরক্ষা দেয়ালে ফাটল খুঁজে পায়।

এছাড়া আরও বড় ধরনের ছয়টি ত্রুটি চিহ্নিত করে। এসবের একটি হলো সেতুর ১ ও ১৫ নম্বর পিলার। যা জাহাজ চলাচলের সময় সংঘর্ষ হলে ভেঙে যেতে পারে। সেতুর গার্ডার, ডেক, অ্যাঙ্গেল, গ্যাসেট প্লেট, রিভেট ও অন্যান্য অংশ ক্ষয়ে গেছে। তাই সেতুটির ভার বহনের ক্ষমতা দিন দিন কমছে। এছাড়া সেতুর ওপরের অংশের অ্যাপ্রোচেও লাইনচ্যুত হওয়ার লক্ষণ দেখতে পান পর্যবেক্ষকেরা।

বুয়েটের প্রতিবেদনে বলা হয়, সেতুতে গার্ডারের ভার বহনকারী ই¯পাতগুলো অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেতুর দুই পাশের কাঠের পাটাতন ও লোহার বেষ্টনী ঠিকঠাকমতো আছে কি না, তা পরীক্ষা করা দরকার। কারণ, এসব যন্ত্রাংশের কাঠামো বেহাল। তবে সেতুর ফাউন্ডেশনে কোনো ত্রুটি পায়নি পর্যবেক্ষক দল।

এ অবস্থায় কালুরঘাট সেতুটি সংস্কারে দরপত্র আহবান করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। এই সেতু সংস্কারে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ৫০-৬০ কোটি টাকা। তবে এখনো কাজ শুরু হয়নি। যে কারণে আগামী সেপ্টেম্বরে ট্রেন চালুর যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তার আগে সংস্কার কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞা বলেন, আমরা দরপত্র যাচাই বাছাই কাজ শেষ করেই কাজ শুরু করে দিব। প্রাথমিকভাবে ১৫ জুন থেকে কালুরঘাট সেতুর সংস্কার কাজ শুরুর টার্গেট নেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম এ প্রসঙ্গে বলেন, সংস্কার করেও এই সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চালানো যাবে না। সংস্কার করে সেতুটি ট্রেন চলাচলের উপযোগী করা হলেও এটি সর্বোচ্চ এক বছর চলবে এবং তা-ও হবে ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং মেয়াদোত্তীর্ণ সেতু সংস্কারের এই অর্থ ব্যয় পুরোটাই হবে অপচয়।

এছাড়া ইঞ্জিন সংকটের কারণেও ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেন চলাচল নিয়ে সন্দিহান বলে জানান রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, রেলওয়েতে বর্তমানে কোচ ও ইঞ্জিন সংকট চলছে। কোরিয়া থেকে আনা ১০টি ইঞ্জিন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পাহাড়তলী ওয়ার্কশপে অকেজো পড়ে আছে। কোচ ও ইঞ্জিন সংকটের কারণে কোথাও একটির বেশি ট্রেন চালু করা যাচ্ছে না।

এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ফৌজদারহাটে বাইপাস নির্মাণ না হওয়ায় কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে জানিয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের কর্মকর্তারা। এছাড়া দোহাজারি সেকশনে পুরানো রেলপথ থাকায় ট্রেন চলাচলে ভুগতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারি পর্যন্ত এই সেকশনে ট্রেন চলবে ধীরে। একইভাবে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে যাত্রাবিরতি দিয়ে কক্সবাজার যাওয়ায় মাঝপথে এক থেকে দেড়ঘণ্টা সময়ক্ষেপন হতে পারে।

প্রকল্পের তথ্যমতে, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ শেষ হয়েছে। কক্সবাজারে আইকনিক স্টেশনে প্লাটফর্ম ও প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ প্রস্তুত করা হয়েছে। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় এই রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, প্রকল্পের ৮৪ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে বাকি কাজ স¤পন্ন করার চেষ্টা করছি। সেপ্টেম্বরের আগেই অন্তত ট্রেন চলার মতো কাজ শেষ করতে চাইছি। পরবর্তীতে হয়তো অন্যান্য কাজগুলো করতে পারবো। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় নিলে এ রুটে আরো ট্রেন চালানো সম্ভব। কিন্তু কোচ ও ইঞ্জিন সংকট রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবগুলো ঠিক হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু করতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পক্ষ থেকে দুটি সময়সূচির প্রস্তাবনা রেলভবনে পাঠানো হয়েছে। প্রথম প্রস্তাবনা ঢাকা থেকে রাত ৮টা ১৫ মিনিটে ছেড়ে ভোর সাড়ে ৫টায় কক্সবাজার স্টেশনে পৌঁছবে। ফিরতি পথে সকাল ১০টায় কক্সবাজার স্টেশন থেকে ছেড়ে সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছবে।

দ্বিতীয় প্রস্তাবনায় ঢাকা থেকে রাত ১১টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে সকাল সাড়ে ৯টায় কক্সবাজার স্টেশনে পৌঁছবে। ফিরতি পথে দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে কক্সবাজার থেকে ছেড়ে রাত ১০টায় ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছবে। এই রুটে আপাতত একটি ট্রেন চলাচল করবে। কোরিয়া থেকে সর্বশেষ আনা মিটারগেজ কোচ দিয়ে এই ট্রেনের রেক সাজানো হবে। কোচ ও ইঞ্জিন সংকটের কারণে একটির বেশি ট্রেন চালানোর জন্য এখনই প্রস্তুত নয় রেলওয়ে।

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page