
রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (চলতি দায়িত্ব) মামুনুল ইসলামকে প্রথম দেখায় যে কেউ ভাবতে পারেন সহজ-সরল সুফি মানুষ। অথচ ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মে নজির সৃষ্টি করেছেন তিনি। অধীনস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতিতে বাধ্য করাও তার স্বভাব। রয়েছে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও।
মিলেছে মামুনুল ইসলামের দুর্নীতি-অনিয়মের একটি ফোনকল রেকর্ড। সেই রেকর্ড করা কথোপকথনে শোনা গেছে, তিনি অধস্তন এক কর্মকর্তার কাছে রূঢ় ভাষায় ঘুষ দাবি করেন। প্রয়োজনে সরকারি প্রকল্পের টাকায় তার গাড়িতে জ্বালানি ভরে দিতে বলেন। মোবাইল ফোনে রেলের প্রকল্পে নিয়োজিত এক অধস্তন কর্মকর্তাকে প্রকল্পের টাকা দিয়ে তার অফিশিয়াল গাড়ির (রাজস্ব খাত) ট্যাক্স-টোকেন রেজিস্ট্রেশন করে দিতে চাপ দেন। তা ছাড়া তিনি ঢাকা আসবেন এবং ঘোরাফেরা করবেন, এ জন্য গাড়ির ট্যাং ভরে জ্বালানি (অকটেন) চেয়েছেন।
ফোনকল রেকর্ডের এক অংশে পশ্চিমাঞ্চলের জিএম মামুনুল ইসলাম তার অধস্তন কর্মকর্তাকে বলেন, ‘তোমাদের কাজ সব এমনি এমনি করে দিলাম। আমি এখনই… ইনস্পেকশন করে দিলাম। আমি এটা হস্তান্তর করব না। যতই দৌড়াদৌড়ি করো। আমি বানের জলে ভাইসা আসি নাই।
কথোপকথনের একপর্যায়ে মামুনুল ইসলাম প্রকল্পের অধস্তন কর্মকর্তাকে বলেন, ‘তিনটা জিনিস বললাম। একটা হলো টাকা। দুই নম্বর হলো ১৯ তারিখ ট্যাক্স-টোকেনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে, এটা এক বছরের জন্য করে দাও তোমাদের প্রকল্পের টাকা দিয়ে। আর তিন নম্বর হলো, গাড়ির ট্যাংক ফুল ভরে দাও। তোমার পিডির (প্রকল্প পরিচালক) সঙ্গে কথা বলবে না কার সঙ্গে বলবে, বলো। আমার জীবনের ওপর দিয়ে তোমাদের জন্য সর্বোচ্চটা করে দিয়েছি। বুঝছ? আমি কাউকে বলতে পারব না। তুমি বলো।’
এই কথোপকথনের পর জিএম মামুনুলের চাহিদামতো গাড়ির ট্যাক্স-টোকেন ও জ্বালানি দিতে বাধ্য হয়েছেন সংশ্লিষ্ট অধস্তন কর্মকর্তা। রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, মামুনুল ইসলামের (৩য় গ্রেড) বিরুদ্ধে আগে থেকেই অনেক অভিযোগ রয়েছে। নানা অনিয়মের কারণে বিতর্কিত এই কর্মকর্তা। জুনিয়র হয়েও সম্প্রতি ছয় কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে পশ্চিমাঞ্চল জিএম পদ বাগিয়ে নেন। মামুনুলের শ্বশুর আমজাদ হোসেন কয়েক বছর আগে রেলের মহাপরিচালক ছিলেন। শ্বশুরের প্রভাবে সেই সময়ে রেলের নিয়োগ, বদলি, পদায়নের মতো নানা কর্মকাণ্ডে সমালোচিত ও বিতর্কিত হন মামুনুল। আরও অভিযোগ রয়েছে যে মামুনুল ইসলাম সপরিবারে থাইল্যান্ডের নাগরিক।
১৮-১২৮৯ নম্বরের এই জিপ গাড়িটি জিএম (পশ্চিম) পদের অনুকূলে বরাদ্দ দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। এই গাড়িটি তাকে ঢাকায় ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু গাড়িটি রাজস্ব খাতভুক্ত পদের অনুকূলে বরাদ্দ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ, তাই এই গাড়ির পেছনে প্রকল্পের টাকা ব্যয় করার কোনো সুযোগ নেই। তবে অধস্তন কর্মকর্তা মামুনুলের নির্দেশে প্রকল্পের টাকা ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদ্য বিদায়ী রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকী জানান, ‘কোনো কর্মকর্তার রাজস্ব পদের অনুকূলে পরিবহন পুল থেকে যদি গাড়ি বরাদ্দের অনুমোদন দেওয়া হয়, তবে সেটা তার পদ-পদবির বিপরীতে সরকারের পক্ষ থেকেই বরাদ্দ দেওয়া থাকে। এটাই নিয়ম। কাজেই কোনো কর্মকর্তা এই গাড়ির কাগজপত্র ঠিক করতে বা তেল ভরতে চাপ দিয়ে থাকলে তা আইনের পরিপন্থি। এমন যদি কোনো কর্মকর্তা করে থাকেন, তবে তিনি অনিয়ম বা অনৈতিক কাজ করেছেন।’
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে জিএম (পশ্চিম) মামুনুল ইসলাম ফোন কলের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, রেলের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ থাকলেও আমার বিরুদ্ধে কখনোই অভিযোগ ওঠেনি। আর কোনো কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে আমাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি, বরং যোগ্যতা অর্জনের ৯ মাস পর আমাকে পদোন্নতি (চলতি দায়িত্ব) দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। যাদের ডিঙিয়ে আমাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে বলে সমালোচনা হচ্ছে, তারা সবাই জিএম পদমর্যাদার দায়িত্ব পালন করছেন। বিদেশে নাগরিকত্ব নেওয়ার কথা কখনোই সত্য নয়। আর ডিজি থাকা অবস্থায় শ্বশুর আমাকে অনেক বেশি বাইপাস (দূরে সরিয়ে রাখা) করে রেখেছিলেন।’