মঙ্গলবার- ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

দেশের রাজস্ব গিলে খাচ্ছে যেভাবে চীন

মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য রফতানি থেকে কোটি টাকার কর ফাঁকি

print news

চীন দেশের অবকাঠামোর উন্নয়নে ব্যাপক ভুমিকা রাখছে সে খবর কারো অজানা নয়। সে কারণে চীনকে বাংলাদেশের ভাল বন্ধুও মনে করা হয়। কিন্তু উল্টো চিত্রও রয়েছে চীনের। একের পর এক মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য রফতানি থেকে মোটা অংকের কর ফাঁকি দিয়ে দেশের রাজস্ব গিলে খাচ্ছে এই চীন।

গত কয়েক বছরে চীন বা বাংলাদেশ ভিত্তিক চীনা সংস্থাগুলির দ্বারা কর ফাঁকির প্রচেষ্টার এমন কয়েকটি ঘটনা সামনে এসেছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক একটি ঘটনা ঘটিয়েছে বাংলাদেশ ভিত্তিক কো¤পানি হান্স ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠানটি ৫ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিতে মিথ্যা ঘোষণায় চীন থেকে আমদানি করেছে পেন্সিল ব্যাটারি ও তালা।

গত ৯ মে মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি ইয়ার্ডে পণ্যের এই চালান ধরা পড়ে বলে জানান চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার (এআইআর শাখা) মো. সাইফুল হক। তিনি জানান, পণ্য চালানটি নিয়ে গত ৫ মে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে সাওয়াসদি আটলান্টিক নামের একটি জাহাজ। পণ্যচালানটি খালাসের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রামের ফকিরহাট এলাকার সিএন্ডএফ এজেন্ট শামীম এন্টারপ্রাইজ এসাইকুডা সিস্টেমে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেন। এরপর কাস্টমস চালানটিতে অসত্য ঘোষণায় পণ্য আমদানি করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়। এ কারণে চালানটি এসাইকুডা সিস্টেমে লক করা হয়।

পরে বন্দরের এনসিটি ইয়ার্ডে এসব পণ্যের তিনটি কন্টেইনারের কায়িক পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা করে দেখা যায় প্রতিটি কন্টেইনারে ২২টি কাঠের প্যালেটের উপর ক্যালসিয়াম কার্বনেট লেখা ২২টি বড় জাম্বু ব্যাগ রয়েছে। ব্যাগগুলোর উভয় পাশে পর্যবেক্ষণ করে ক্যালসিয়াম কার্বনেট পাওয়া যায়। ব্যাগগুলো পর্যবেক্ষণে কোনভাবেই এর ভিতর অন্য কোন পণ্য রয়েছে বলে সন্দেহে হবে না।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

পরে বস্তাগুলো কেটে তল্লাশি করে ব্যাগের ভিতর ক্যালসিয়াম কার্বনেটের নিচে লুকানো অবস্থায় কিছু কার্টন পাওয়া যায়। কার্টনগুলো কেটে ভেতরে বিভিন্ন সাইজের পেন্সিল ব্যাটারি ও তালার সন্ধান মেলে। পরবর্তীতে তিন কন্টেইনারের সকল বস্তা কেটে প্রায় ১.৭ মিলিয়ন টুকরো পেন্সিল ব্যাটারি ও প্রায় ১৮ মেট্রিক টন তালা পাওয়া যায়। এ ঘটনায় কো¤পানি এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের মামলা শুরু করা হয়েছে।

Ctg Cina ponno 20.05.2023 File pic 1ক্যালসিয়াম কার্বনেট আমদানির মিথ্যা ঘোষণার অনুরূপ ক্ষেত্রে, গুয়াংডং ভিত্তিক একটি চীনা কো¤পানি সিনো-কেমেড ট্রেডিং কো¤পানি ২০২২ সালের মে মাসে তার ঢাকা ভিত্তিক সহযোগী ‘এনবি ট্রেডিং হাউস’-এর কাছে প্রলিপ্ত ক্যালসিয়াম কার্বনেটের চালান পাঠানোর ঘোষণা করেছিল। মালামাল পরীক্ষার সময় বাংলাদেশের কর্মকর্তারা ১২০ টন উচ্চ মূল্যের ডেক্সট্রোজ মনোহাইড্রেট উদ্ধার করেছেন। ডেক্সট্রোজ বাদামী কার্টনের (সংখ্যায় ৪৮০০) ভিতরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল যদিও লেবেলটি দেখায় যে তারা ভিতরে ক্যালসিয়াম কার্বনেট প্রলেপ দিয়েছে।

চালানটি চীনের কিনগাডো বন্দর থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছায়। চালানটি পাঁচটি পাত্রে বহন করা হয়েছিল। সময়মতো ধরা না পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরকারি কোষাগারের ৪২ লাখ ১৩ হাজার টাকার ক্ষতি হতো।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ একটি কন্টেইনার জব্দ করেছিল যাতে চীন থেকে রফতানি করা টেক্সটাইল ডাই স্টাফ থাকার কথা ছিল। তবে কন্টেইনারটি খুললে দেখা যায়, সাত কোটি টাকার প্রায় ৯০০ প্যাকেট বিদেশি সিগারেট ভর্তি।

বিদেশী সিগারেটের অবৈধ আমদানির আগের একটি মামলায় চীনা কো¤পানি কমফ্লাই আউটডোর কো. লিমিটেড-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান তিয়ানয়ে আউটডোর (বিডি) কো. লিমিটেড (টিওসিএল) ২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা কর ফাঁকির সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণিত হয়েছে। চালান থেকে উচ্চ শুল্কযুক্ত বিদেশী সিগারেট উদ্ধার করা হয়। অথচ চীন থেকে তুলা সুতা আমদানি করা হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

এছাড়া চীনের নিংবো কনডা আর্ট সাপ্লাইর্স গ্রুপ কো. লিমিটেড এর সহযোগী কো¤পানি কনডা আর্ট মেটেরিয়ালস বাংলাদেশ কো লিমিটেডের কর ফাঁকি দেওয়ার একটি ঘটনাও প্রকাশ্যে এসেছে। এ কো¤পানি চীন থেকে মেড ইন বাংলাদেশ লেবেলযুক্ত পণ্য বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি করেছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তাদের প্রায় ২০০টি চালানের মধ্যে ২৮ কোটি টাকারও বেশি পাচারের সন্দেহ করছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, কনডা আর্ট মেটেরিয়ালস বাংলাদেশ ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) এর নীতি লঙ্ঘন করেছে। নীতি অনুযায়ী, তারা কেবলমাত্র কাঁচামাল আমদানি করতে পারবে। কিন্তু কো¤পানিটি কাঁচামালের পরিবর্তে তৈরি পণ্য আমদানি করে একই পণ্য অন্য দেশে রফতানি করে আসছিলো দীর্ঘকাল ধরে।

Ctg Cina ponno 20.05.2023 File pic 2শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার সন্দেহে কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের এপ্রিল এবং মে মাসে কো¤পানিটির প্রায় ১০টি ভ্যান এবং পণ্য বোঝাই ৭ টি কন্টেইনার জব্দ করে। বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কয়েকজন কর্মকর্তাকে ঘুষ দেওয়ার মাধ্যমে এ ভ্যান এবং কন্টেইনারগুলো চীন থেকে আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি।

ওই বছরের জুলাই মাসেও কর্তৃপক্ষের বিশেষ অভিযানে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কে চীন থেকে আসা ২৭০০ কার্টন বিদেশী মদের একটি বড় চালান আটক করা হয়। জানুয়ারিতে ডিজি অ্যান্টি-ফেক নামের এক চীনা কো¤পানি ২৫০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়ে নকল ব্যান্ডরোল (বিড়ি এবং সিগারেটের প্যাকেটের চারপাশে মোড়ানো একটি পাতলা ব্যান্ড) সরবরাহ করে। জাল বাংলাদেশি পাসপোর্ট, ব্যালট পেপার, জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন সনদ ছাপানোর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার মুশফিকুর রহমান বলেন, কর ফাঁকি দিতে চীনের মিথ্যা ঘোষণায় বাংলাদেশে পণ্য রফতানির প্রবণতা রয়েছে। অনুমানগুলি প্রস্তাব করে যে চীন বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলির কাছে মূল্যের দ্বারা দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক অনুশীলনের সাথে স¤পর্কিত বৃহত্তম অবৈধ আর্থিক প্রবাহের জন্য দায়ী। যদিও বেইজিং নিজেকে একটি নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক অংশীদার হিসাবে প্রজেক্ট করে। তবে এর অর্থনৈতিক ব্যস্ততা দুর্নীতি এবং অপরাধে পরিপূর্ণ।

চবির ব্যবসায় অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. হেলাল উদ্দিন নিজামী বলেন, দক্ষিণ-এশিয়া অঞ্চলে চীনের অর্থনীতি প্রায়শই দুর্নীতি এবং অপরাধের সাথে জড়িত থাকে। চীন সরকার আনুষঙ্গিক কো¤পানিগুলো এই অঞ্চলে অন্যায্য সুবিধা পেতে প্রায়ই দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। অনুমান করা যায় যে বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যবসাক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং এর সাথে স¤পর্কিত বৃহত্তম অবৈধ আর্থিক প্রবাহের জন্য চীন দায়ী।

২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে চীন বাংলাদেশের অবকাঠামোতে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১৬ সালে অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় স্বাক্ষরিত বেশ কয়েকটি চুক্তির প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বেশ কয়েকবার নির্ধারিত সময়সীমা পার করার পর কর্ণফুলী মাল্টিপল রোড টানেল প্রকল্পের কাজ ২০১৭ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উদ্বোধন করেন যা ২০২০ সালে এসে শুরু হয়। চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কো¤পানি লিমিটেড দ্বারা নির্মিত টানেল প্রকল্পটি ২০২৩ সালের এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি।

আরও পড়ুন

No more posts to show
error: Content is protected !!