বৃহস্পতিবার- ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫

আজাদ হত্যায় চসিকের প্যানেল মেয়র লিটন?

জড়িত চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ছিনতাই, জুঁয়া ও মাদক পাচারে

print news

চট্টগ্রামের পাহাড়তলী নয়াবাজার বিশ্বরোড এলাকায় মোহাম্মদ আজাদ (৩০) নামে এক নিরাপত্তাকর্মী একদল কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে মারা গেছে। রবিবার (২৮ মে) ভোরে এ ঘটনা ঘটে। আর এই কিশোর গ্যাং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটনের ভাই আবদুল মান্নানের খোকনের অনুসারী বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয়রা জানান, নিহত আজাদ ওই এলাকার নাজিরবাড়ির লাডু ইব্রাহিমের ছেলে। তার দুটি শিশু সন্তান রয়েছে। চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে প্যানেল মেয়র লিটনের নির্দেশে আজাদকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তার স্ত্রী নাজু বেগম।

নিহতের স্ত্রী নাজু বেগম স্বামীর শোকে বিলাপ করার সময় অভিযোগ করে বলেন, হোসেন, ফয়সাল, রাজু, ওসমানসহ সাতজন মিলে আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। লিটন কমিশনারের কারণে এই ছেলেগুলো আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে। আমার দুইটা মেয়েকে এতিম করে ফেলেছে। লিটন কমিশনারের ফাঁসি চাই। কিশোর গ্যাংয়ের সবার ফাঁসি চাই।

তিনি বলেন,এরা চাঁদাবাজি, ডাকাতি, চুরি করে। কিছুদিন আগে নগরের নয়াবাজার এলাকায় চাঁদাবাজিতে বাধা দিয়েছিল আজাদ। পরবর্তীতে তিনি নামাজে যাওয়ার সময় পথ আটকে তাকে ছুরিকাঘাত করে কিশোর গ্যাংয়ের দুর্বৃত্তরা। এসময় গুরুতর আহত অবস্থায় আজাদকে চমেক হাসপাতালে নেওয়ার সময় খুনিদের নাম আবুল হাসনাত রাজু প্রকাশ রাজু, ফয়সাল ও ওসমান বলে জানায় আজাদ। এরপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

এদিকে তার জবানবন্দির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। নিহতের স্বজনেরা জানান, রবিবার ভোর ৪টার সময় ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যাচ্ছিলেন মোহাম্মদ আজাদ। এসময় তার বাড়ির সামনে পথরোধ করে একদল কিশোর দুর্বৃত্ত। একপর্যায়ে তারা তাকে পেটে ছুরিকাঘাত করলে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসে। পরে ঘাড়ে, হাতে ও মাথায় ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। আজাদের চিৎকার শুনে তার স্বজনরা বাড়ি থেকে দৌঁড়ে ছুটে আসে। এসময় দেখতে পান আজাদ রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন। পরে তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত আজাদের বড় ভাই মতিউর রহমান বলেন, আমার ভাইকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে রাজু, ফয়সাল ও ওসমানসহ তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা। তারা সবাই প্যানেল মেয়র ও রামপুরা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুস সবুর লিটনের ভাই খোকনের অনুসারী। আমরা ভাই হত্যার বিচার চাই। শুধুমাত্র চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় তারা আমার ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।’

di0024
আজাদ হত্যায় স্ত্রী নাজুর বিলাপ

তিনি আরও বলেন, কয়েকদিন আগে ফয়সাল, রাজু ও ওসমানরা তাদের গ্রুপ নিয়ে ওই এলাকায় কয়েকটি দোকান থেকে চাঁদা দাবি করে আসছিল। তাদের চাঁদাবাজিতে বাধা দেয় আমার ভাই আজাদ। আর এ ঘটনার জের ধরেই তারা ভোররাতে ফজরের নামাজের সময় আমার ভাই আজাদকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে।

মতিউর রহমান বলেন, ওরা লিটন কমিশনারের লোকজন। লিটন কমিশনারের ভাইয়ের সাথে থাকে ওরা। দুই মাস আগে বাজার থেকে চাঁদা নেওয়ার সময় ২৫ নাম্বার ও ১২ নাম্বার ওয়ার্ড ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। দোকান বসালে ওদেরকে টকা দিতে হবে একথা বলেছিল। বলার পর এটা নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়েছিল। আমরা সামাজিকভাবে এটা সমাধান করেছিলাম। ওদের এতো টাকা থাকার পরও ভ্যানগাড়ি থেকে ৪০০-৫০০ টাকা চাঁদা খাওয়ার জন্য কী ছেলে-পেলে পাঠানো লাগে। এরা কোনো দোকান বাকি রাখে না। সব দোকান থেকে চাঁদা নেয়। আজাদ তো দারোয়ানি করে চলে।’

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আজাদ একজন নিরপরাধ, সহজ-সরল, খেটে-খাওয়া মানুষ। নতুন বাজার এলাকায় গাড়ির গ্যারেজের পাহারাদার হিসেবে কাজ করতেন৷ মাঝেমধ্যে বড়শি শিকারিদের সঙ্গে যেতেন। শ্রমের বিনিময়ে সামান্য টাকা উপার্জন করে পরিবার চালাতেন। হত্যাকারীরা আগে থেকেই আজাদকে চিনতো। এর আগে তাদের সঙ্গে চাঁদা নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়েছিল। হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি একই এলাকার বাসিন্দা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযুক্তরা সবাই কাউন্সিলর খোকনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন দোকানে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, জুয়া ও মাদকের কারবার করে এলাকায় রীতিমতো ত্রাস সৃষ্টি করে আসছে তারা। কাউন্সিলর লিটন ও খোকনের সাথে মূল অভিযুক্ত আবুল হাসনাত রাজুর তোলা একাধিক ছবি রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, কাউন্সিলর লিটনের ছোট ভাই খোকনের বেপরোয়া-বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ওই এলাকার সাধারণ মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত। এলাকায় নিত্য চাঁদাবাজি, জুঁয়ার আসর, মাদক সেবন ও পাচারসহ নানা অপরাধ করে বেড়ায় খোকন। আর অনুসারী হিসেবে পরিচিত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এসব অপরাধ কর্মকান্ডের প্রত্যক্ষ সহযোগী।

আব্দুল মান্নান খোকনের বিরুদ্ধে নগরের পাহাড়তলীর ভেলুয়ার দীঘি ও ডেবার পাড় এলাকায় বড়শি প্রতিযোগিতার আড়ালে দিনে-দুপুরে জমজমাট জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ আছে, বড়শি প্রতিযোগিতার নামে এ জুয়ার আসরের আয়োজন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন খোকন। আর সবকিছুর মূলে প্যানেল মেয়র আবদুস সবুর লিটন।

এর আগে ২০২১ সালের ৩ মে হালিশহর থানার ঈদগা বড়পুকুর পাড় এলাকার একটি অসহায় পরিবারের উপর হামলা অভিযোগ উঠে আবদুল মান্নান খোকনের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, তাদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে চাঁদা দাবি করে আসছিলেন খোকন। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে নিজে উপস্থিত থেকে কিশোর গ্যাং দিয়ে প্রকাশ্যে ওই পরিবারের উপর হামলা চালান খোকন। এসময় একটি রিকশা গ্যারেজ এবং ঘর ভাঙচুরের পাশাপাশি ওই পরিবারের সদস্যদের মারধরের অভিযোগ তুলেন ভুক্তভোগীরা।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটনের ছোট ভাই আব্দুল মান্নান খোকনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় জানার সাথে সাথেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এমনকি প্যানেল মেয়র ও নগরীর ২৫ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুস সবুর লিটনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

পাহাড়তলী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রোজিনা আক্তার বলেন, ‘মৃত্যুর আগে ভিকটিম খুনিদের নাম বলে গেছেন৷ সে হিসেবে আমরা ধরে নিয়েছি এরাই খুনি। ভিকটিমের দেয়া তথ্যমতে রাজু, তার ভাই রাজীব, ওসমান ও ফয়সাল এ খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদেরকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। মরদেহ বর্তমানে চমেক হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে বলেও জানান তিনি।

আরও পড়ুন