
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক শাখার কর্মকর্তা (এসএসএই) মো. গোলাম মোস্তফার বাপদাদার সম্পদ ছিল চট্টগ্রামের আমবাগান রেলগেইট নিউষ্টোর ডিপো। যেখান থেকে রেলের কোটি কোটি টাকার যন্ত্রাংশ বিক্রির অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। যা জেনেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি এ বিষয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে তাকে নিউষ্টোর ডিপো থেকে তড়িঘড়ি করে বদলি করা হয় মাত্র ৪০০ মিটার দূরে শপ ডিপোতে। যেখানে সুযোগ রয়েছে আরও বেশি অনিয়ম ও দূর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ লুটের। ফলে সুখকর এই বদলি দূর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তার জন্য শাস্তির বদলে হয়ে উঠেছে পুরস্কার।
এমন ভাষ্য রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারি ও ঠিকাদারদের। তাদের মতে, এই বদলিতে মোটেও বিচলিত নন জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক শাখার কর্মকর্তা (এসএসএই) মো. গোলাম মোস্তফা। তিনি নিজেই বলছেন, এ তো সুখকর বদলি। চেয়ার পরিবর্তন হলেও ডিপোতে তো আছে।
কর্মকর্তা-কর্মচারি ও ঠিকাদাররা জানান, চট্টগ্রামের আমবাগান রেলগেইট নিউষ্টোর ডিপোতে নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২০টি বিভাগীয় মামলা রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে যন্ত্রাংশ গুদামজাতকরণে মোটা অংকের কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগও। একাধিক অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। এরপরও এতটুকু লোম নড়েনি গোলাম মোস্তফার।
ডিপো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যমতে, রেলওয়ের নিউষ্টোর ডিপোতে বর্তমানে রেলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের অধীনে ক্রয়কৃত এক তৃতীয়াংশ যন্ত্রাংশের হদিস নেই। যা শুধুমাত্র কাগজে-কলমে আছে। এ সংক্রান্ত একাধিক অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। আবার অনেক তদন্ত টিম মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে বিষয়টি ধামাচাপাও দিয়েছে। তবে একসাথে একাধিক তদন্ত টিম বা অডিট করা হলে ডিপোর প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের অধীনে ক্রয় করা রেলের যন্ত্রাংশ গুদামজাত রাখা হয় এই ডিপোতে। যা বুঝে নেওয়ার সময় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ পারসেন্ট হারে কমিশন নেন গোলাম মোস্তফা। আবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীর সাথে গোপন চুক্তির মাধ্যমে কাগজে-কলমে যন্ত্রাংশ বুঝে নেওয়ার ভুয়া নথি বুঝে নিয়ে যন্ত্রাংশ ক্রয়ের পুরো টাকা হাতিয়ে নেয়।
ডিপো থেকে যন্ত্রাংশ ছাড়িয়ে নেওয়ার সময়ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজনকে ম্যানেজ করে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে যন্ত্রাংশ বুঝে পাওয়ার নথি তৈরী করে। এভাবে কয়েক বছর ধরে কোটি কোটি টাকা আত্নসাৎ করে আসছেন গোলাম মোস্তফা। এছাড়া আরএনবির যোগযাজশে ডিপো থেকে যন্ত্রাংশ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০১৬ সালের আগস্টে ১৫০টি ব্রডগেজ ও মিটারগেজ কোচ আমদানি করে। ১০০টি মিটারগেজ কোচের সঙ্গে ক্যাপিটাল ¯েপয়ার পার্টসও দেয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রেলওয়ের সরঞ্জাম শাখা এসব যন্ত্রাংশ রেলের বৈদ্যুতিক শাখাকে বুঝিয়ে দিতে পারেনি।
তদন্তকারী এক কর্মকর্তা জানান, ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশগুলো সরঞ্জাম শাখায় রক্ষিত থাকলেও সেগুলো অবৈধ পন্থায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এসব যন্ত্রাংশ ফেরত দিতে একাধিকবার চিঠি ও নির্দেশনা দেওয়ার প্রেক্ষিতে এক-চতুর্থাংশ যন্ত্রাংশ বুঝিয়ে দিলেও ষ্টোরে সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে না।
তদন্ত কর্মকর্তারা আরও জানান, ইন্দোনেশিয়ার কোচের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৩০টি টে¤পারেচার সেন্সরও আত্নসাৎ করেছেন জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক শাখার কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা। এই যন্ত্রাংশ চুরি নিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবরে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয় গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে। এতে বলা হয়, ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা ১০০ এমজি কোচের ক্যাপিটাল ¯েপয়ার পার্টসের সঙ্গে এসি ইউনিটের দুই ধরনের মোট ৪০টি টে¤পারেচার সেন্সর সরবরাহ করা হয়। ওই ৪০টি মালামালের মধ্যে ১০টি এসএসএই ইনচার্জ (এসি), পাহাড়তলী ডিপো থেকে সরবরাহ নিলেও বাকি ৩০টি মালামাল সরবরাহ পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি নি®পত্তির লক্ষ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই তদন্তে প্রমাণিত হয়, গোলাম মোস্তফা এর জন্য দায়ী। এ বিষয়ে মো. গোলাম মোস্তফাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি তদন্ত কমিটিকে বলেন, তিনি এসব সেন্সর সরবরাহ করেছেন। তবে এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি।
এ কারণে গোলাম মোস্তফাকে চুরির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এ ছাড়া আর্থিক ক্ষতি নির্ধারণপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। এরপরও ক্ষতিপূরণ কিংবা মূল্যবান যন্ত্রাংশ আদায়ের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়।
এ ছাড়া ২০২৩ সালের ২৬ আগস্ট কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশন এলাকা থেকে ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন ডিপোর টুল ভ্যানের প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের মালামাল চুরি হয়। এছাড়া পূর্বাঞ্চল রেলের প্রধান কার্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের অধীনে থাকা স্টোরে গত এক বছরে ৪-৫ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ চুরি ও উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনায় রেলওয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে। নানা অভিযোগে গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২০টি বিভাগীয় মামলা চলমান রয়েছে। এটি উল্লেখ করে গত ১৪ জুলাই সিনিয়র সহকারী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সরঞ্জাম শাখা) আসাদুল্লাহ শরীফ একটি চিঠি দেন গোলাম মোস্তফাকে।
এর আগে ৬ জুন গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ২০টি অভিযোগের প্রমাণসহ সহকারী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক আলমগীর কবিরও একটি চিঠি ইস্যু করেন। সেখানে যন্ত্রাংশ চুরির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এরপরও কোনরকম মালামাল উদ্ধার করা হয়নি। তবে সম্প্রতি কয়েকটি গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ হলে দুনীতিবাজ কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফাকে নিকটবর্তি শপ ডিপোতে বদলি করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে মো. গোলাম মোস্তফার মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। মেসেজ অপশনে নিউজ সংক্রান্ত বিষয়ে বক্তব্য জানতে বার্তা প্রেরণ করা হলেও তিনি কোন রকম সাড়া দেননি। এমনকি শপ ডিপোতে গেলেও জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক শাখার কর্মকর্তা (এসএসএই) মো. গোলাম মোস্তফাকে অফিসে পাওয়া যায়নি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পূর্ব) আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, অভিযোগ এবং নিজেও থাকতে না চাওয়ায় গোলাম মোস্তফাকে শপ ডিপোতে বদলির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা কি পুরস্কার হল, না হল না, কে কি ভাবল, না ভাবল তাতে আমাদের কি এসে যায়।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, বদলি নিয়ে তিনি যাই ভাবুক, ডিপো থেকে গায়েব হওয়া যন্ত্রাংশ বুঝিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে তাকে কাছের শপ ডিপোতে বদলি করা হয়েছে। শুধু গোলাম মোস্তফা নয়, এ ঘটনার সাথে আরও কেউ জড়িত থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।