মঙ্গলবার- ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

পেট্রো-ডলার চুক্তি শেষ, রাজত্ব হারাবে ডলার

তেজ বাড়ছে ইউয়ান-রুবল-রুপির

পেট্রো-ডলার চুক্তি শেষ, রাজত্ব হারাবে ডলার
print news

লার অবরোধকে হাতিয়ার করে বিশ্বে জায়নবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যার পেছনে শক্তি যুগিয়েছিল পেট্টো-ডলার চুক্তি। কিন্তু শেষ হয়ে গেল পেট্রো-ডলারের চুক্তি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাজারে ডলারের দাম বাড়িয়ে বিশ্বে পেট্রো-ডলারের হারানো জায়গা দখলের প্রচেষ্টা চালালেও হিতে-বিপরীত হয়েছে। তাতে একচেটিয়া রাজত্ব হারানোর উপক্রম ডলারের।

এ সুবাধে এবার চীন-রাশিয়া-ভারত চাচ্ছে নিজেদের মুদ্রায় ব্যবসা করতে। ফলশ্রুতিতে প্রাথমিক পর্যায়ে গত বৃহ¯পতিবার (২৭ জুন) ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই) এক বিজ্ঞপ্তিতে ২০২৪ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য নতুন কারেন্সি সোয়াপ কাঠামো ঘোষণা করেছে। এতে নানা ধরনের ছাড় সুবিধা দিবে ভারত। এতে করে কমবে ডলার নির্ভরশীলতা ও ডলারের একাধিপত্য। বাংলাদেশ সরকার ও ডলারের পরিবর্তে ভারতের রুপি, চীনের ইউয়ান বা রাশিয়ার রুবলে লেনদেনের রাস্তা খুঁজছে।

সারাবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার জুজু অথবা ডলার অবরোধের ভয় দেখিয়ে একাধিপত্যের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। মারণাস্ত্র ও জীবাণু অস্ত্রের পরীক্ষা কেন্দ্র বানিয়ে ধ্বংস করেছে ভিয়েতনাম, ইরাক, ইরান, লিবিয়া, আফগানিস্তান ও সিরিয়া। ডলার ভোগী গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী ব্যবহার করে আরব বসন্তের ঢেউ তুলে দেশে দেশে বসিয়েছে নিজেদের আজ্ঞাবহ স্বৈরাচারী পুতুল সরকার।

ডলার অবরোধ ও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে রেখেছে পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা। যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট সৌদি জোট বনাম ইয়েমেনের হুতি যুদ্ধ, আর্মেনিয়া আজারবাইজান যুদ্ধ, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, হামাসের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রে বলিয়ান ইসরাইলের সংঘাত, চীন তাইওয়ান ইস্যু, চীন ভারত সীমান্ত বিরোধ বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার চরিত্র আমাদের চোখের সামনে দ্রুত বদলে যাচ্ছে।

আমাদের অজান্তে বর্তমানে দ্রুত বদলে যাওয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় বড়সড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। যেহেতু আমরা দেশের এবং দেশের বাইরের তুচ্ছ থেকে অতিতুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তাই কিছুই টের পাচ্ছি না। কিন্তু এখন পরিবর্তনশীল বিশ্বে এমন ঘটনা ঘটছে যার ফলে বিশ্বব্যবস্থা আর আগের মতো নাই। বাংলাদেশে বসে সেটা আমরা এখনও সরাসরি টের পাচ্ছি না। কিন্তু অতিসত্বর আমরা টের পেতে শুরু করব।

“গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল” যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে তুরস্ক, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের মতো রাষ্ট্র। দীর্ঘ পরীক্ষিত বন্ধু সৌদি আরব ও তলপি বাহক আরব রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে পরিত্যাগ করে ঝুঁকছে চীন রাশিয়া ও ইরান জোটের দিকে। বিশ্বের ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটোজোট ও সাম্রাজ্যবাদী শোষক পশ্চিমা জোটের বলয় থেকে বের হয়ে জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে চীন রাশিয়ার ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর সাথে। এর মাধ্যমে শেষ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যবস্থায় “সুপারপাওয়ার” তকমা লাগিয়ে মানবাধিকার ও জঙ্গিবাদের আড়ালে অস্ত্র ব্যবসার মাধ্যমে সারাবিশ্বে রামরাজত্ব কায়েম করা যুক্তরাষ্ট্রের একাধিকত্ববাদ।

সবার ভাবনা হচ্ছে এখন জ্বালানি তেলের বাজারে ডলারের কী অবস্থান হবে। ডলার কী পারবে নিজের এতকালের অবস্থান ধরে রাখতে? নাকি ডলারের জায়গা দখল করে নিবে চীনের ইউয়ান, রাশিয়ার রুবল কিংবা ভারতের রুপি। এখন ‘সুপারপাওয়ার’ ধারণার ওপরে নির্ভর করে বিশ্বেকে একা আধিপত্য করে বেড়াবে। কিন্তু বিশ্ব এখন এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না, বিশ্ব শাসনের হাতিয়ার আসলে কার হাতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চীন-ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও আরব বিশ্বের সঙ্গে মার্কিনীদের শীতল স¤পর্ক পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তুলছে। অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, নিভে যাওয়ার আগে দপ করে জ্বলে উঠেছে ডলার। শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে জ্বালানি তেলের বাজারে ডলারের একাধিপত্য। চাইলেই শুধু ডলার ছাপিয়ে সারা দুনিয়া থেকে বাকিতে মাল কেনার সুযোগ শেষ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের।

সৌদি আরব ৮ জুন ১৯৭৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে পেট্রো-ডলার চুক্তি করেছিল সেটা গত আট জুন,২০২৪ তারিখে শেষ হয়েছে। নতুন চুক্তি হয়নি। এর মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সৌদি আরবের ৮০-বছরের পেট্রো-ডলার চুক্তি নবায়ন হচ্ছে না। খুবই গুরুত্বপূর্ণ খবর হল বিগত ৯ জুন রবিবার মেয়াদ শেষ হওয়া এই চুক্তিটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের ভিত্তি। ডলার ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থায় বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনীতির মঞ্চে মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখার প্রধান হাতিয়ার।

“পেট্রোডলার” শব্দটি তেল ও ডলারের সংযুক্তি বোঝায় এবং তার দ্বারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও মূদ্রাব্যবস্থার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বব্যাপী ডলার কেন্দ্রিক বেচাকেনা নিশ্চিত করবার জন্য মার্কিন-সৌদি পেট্রো-ডলার চুক্তি গড়ে উঠেছে এবং এই চুক্তি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও মূদ্রা ব্যবস্থায় নির্ণায়ক ভূমিকা রেখেছে। পেট্রোডলার জীবাশ্ম জ্বালানি ও ডলারের বিশেষ সম্বন্ধ নির্দেশ করে যা গত শতাব্দির সত্তর দশক থেকে বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে আসছে। পেট্রোডলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও মূদ্রা ব্যবস্থায় বিশেষ সৌদি-মার্কিন চরিত্র দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল বিক্রির মূদ্রা বা মাধ্যম কি হবে তার পেট্রোডলার চুক্তির দ্বারা সেটাই নির্ধারিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পেট্রোডলার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন মোড়কে সাম্রাজ্যবাদ কায়েমে সহায়তার হাতিয়ার করে দিয়েছে।

মুলত এই চুক্তির সার কথা হচ্ছে পেট্রোলিয়াম, তেল বা জীবাশ্ম জ্বালানি বিক্রির আন্তর্জাতিক মূদ্রা হবে ডলার। তেল রপ্তানিকারক দেশগুলির সাথে তেল কেনাবেচা করতে হবে মার্কিন ডলারে। এতে পরিষ্কার পেট্রোডলার ব্যবস্থা বিশ্ব অর্থনীতি ও ভূরাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বহাল রাখার নীতি ও কৌশলও বোঝায়। এটা যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের নতুন একটি ধরন, যা লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ বইতে নাই। এই সম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার বলি হয়েছেন ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি।

১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে ব্রেটন উডস সিস্টেমের পতন ঘটে, অর্থাৎ বিশ্ববাণিজ্যে স্বর্ণভিত্তিক লেনদেনের যে ব্যবস্থা ছিল সেটা ভেঙে পড়ে, তখন সোনার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক মূদ্রা হিসাবে ডলার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্য দিয়ে কার্ল মার্কসের মূদ্রাতত্ত্বও ঐতিহাসিক ভাবে সত্য ও সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ মূদ্রা বা টাকার আবির্ভাবের সঙ্গে সোনা বা কোন ধাতব মূল্যবান বস্তুর স¤পর্ক নাই। কড়ি, রূপা, স্বর্ণ, বা যেকোন বস্তু পণ্য বিনিময়ে টাকা বা মূদ্রার ভূমিকা পালন করতে পারে। স¤পত্তিতে ব্যাক্তিগত মালিকানা থাকলে ব্যক্তিগত
মালিকদের উৎপাদিত পণ্য বেচাকেনার তাগিদ, চাহিদা, প্রয়োজনীয়তা থেকেই স্বর্ণ, মূদ্রা, টাকা ও পুঁজির উৎপত্তি ঘটে। তাই মার্কসের বিখ্যাত পুঁজি গ্রন্থ শুরু হয়েছে পণ্য বিনিময় ও মূদ্রা (চধৎঃ ঙহব: ঈড়সসড়ফরঃরবং ্ গড়হবু) দিয়ে, কলকারখানার উৎপাদন কিম্বা শ্রমিকের শোষণতত্ত্ব দিয়ে নয়।

১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে শুরু হওয়া আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, যা আরবদের কাছে অক্টোবর যুদ্ধ এবং ইসরায়েল তথা পশ্চিমাদের কাছে ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধের অংশ হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছিল সৌদি আরবসহ অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী আরব দেশ। তেল সরবরাহ বন্ধ করার ফলে পশ্চিমা বাজারে তেলসহ অন্যান্য পণ্যের দাম আকাশ ছুঁতে শুরু করে। ১৯৭৪ সালে আমেরিকার মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। অর্থনীতি ব্যাপক চাপে পড়ে যাওয়ায় সৌদি আরবের সঙ্গে ১৯৭৪ সালের ৮ জুন তথাকথিত নিরাপত্তার বিনিময়ে ডলার ছাড়া অন্য কোনো মুদ্রায় কারও কাছে তেল বিক্রি না করার শর্তে চুক্তি করে আমেরিকা। চুক্তির ফলে আমেরিকার অনেক সুবিধা হয়ে যায়, তেলের সরবরাহ নিরঙ্কুশ হয়; সৌদি আরবসহ প্রায় পুরো আরবের ওপর নিয়ন্ত্রণ আসে; আরব দেশগুলো মার্কিন সংস্কৃতি এবং পণ্যের বাজারে পরিণত হয়। তেলের বিনিময়ে কাগজ ছাপিয়ে দিয়ে দিলেই হয়। তাও সব দিতে হয় না। অর্ধেকের বেশি জমা থাকে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। আর কোন দেশের সাথে মতের অমিল হলে বা দেশটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে তার উপর নেমে আসে ডলার অবরোধের চাপ। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শত্রু ভাবাপন্ন অনেক দেশকে ধ্বংস করেছে অবরোধের পিষ্ট কলে।

জায়নবাদ (তরড়হরংস) ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখার পেছনে কিভাবে বৈশ্বিক ডলার ও সুদি ব্যবস্থা এবং সেই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য মার্কিন সামরিক-ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স বা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল হত্যাযজ্ঞ ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ স¤পর্ক রয়েছে। সেটা আমাদের ভাল ভাবে বোঝা দরকার। কারন লেনিনোত্তর আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ বৈশ্বিক সুদি ব্যবস্থার বিশেষ রূপ মাত্র যেখানে নির্ধারক শক্তি হচ্ছে সুদ খোর ব্যাংক। বিশ্ব বাণিজ্যে স্বর্ণভিত্তিক লেনদেন ব্যবস্থার পতনের পর পেট্রোডলার সিস্টেমের আবির্ভাব ঘটে, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন মার্কিন ডলারের সোনায় সরাসরি রূপান্তর প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকারের অবসান ঘোষণা করেন। পরিবর্তে নতুন অনেকগুলো চুক্তির মধ্যে বিশেষ ভাবে পেট্রো-ডলার চুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। যার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা দ্রুত গড়ে উঠতে পেরেছে। পেট্রোডলার চুক্তি দ্বারা বিশ্ব ব্যাপী মার্কিন অর্থনৈতিক আধিপত্যকে মজবুত করবার পথও পোক্ত করে।

৮ জুন ২০২৪ তারিখে সেই চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটল। আমরা ইতিহাসের নতুন একটি কালপর্বে প্রবেশ করছি। পাশাপাশি হামাসের অভিযান, আল আকসা ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরাচার শাসকদের স¤পর্ক ‘স্বাভাবিক’ করবার যে প্রক্রিয়া চালিয়ে আসছিল সেখানে বড়সড় ধাক্কা লেগেছে। বিশ্বব্যবস্থার শূন্যস্থান পূরণের দৌড়ে রাশিয়া, চীন ও ভারত বা ব্রিকসের মত জোট। আমরা গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝতে পারবো ডলারের পতন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের একাকীত্ববাদের পূর্বাভাস।

ঈশান/মখ/সুপ

আরও পড়ুন

No more posts to show

জনপ্রিয়

error: Content is protected !!