
ফেনী নদীর মিরসরাইয়ের মোবারকঘোনা থেকে অলিনগর গ্রাম পর্যন্ত অন্তত ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে অবাধে বালু তোলার মহোৎসব। নাম মাত্র এলাকা ইজারা নিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের পাশাপাশি আশপাশের কৃষিজমির মাটিও কেটে নিচ্ছে বালুদস্যুরা। এর ফলে অন্তত কয়েকশ পরিবার, সহস্রাধিক কৃষক এবং নদীর মাছসহ অন্যান্য জলজপ্রাণি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
করেরহাট ইউনিয়নের অলিনগর, জয়পুর পূর্বজোয়ার, পশ্চিম জোয়ার, শুভপুর, হিঙ্গুলী ইউনিয়নের আজমনগর, ধুমঘাট, ধুম ইউনিয়নের পশ্চিম মোবারকঘোনা ও পূর্ব মোবারকঘোনা গ্রাম, ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুর ইউনিয়নের সোনাপুর ও তীলক চর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বছরের পর বছর কৃষিকাজ করে আসা মানুষদের জিম্মি করে তাদের কৃষিজমি জোরপূর্বক কেটে নিচ্ছে বালুদস্যুরা। এসব জমিতে প্রায় শতাধিক কার্টার মেশিন (মাটি কাটার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র) বসিয়ে প্রথমে মাটি কেটে সেগুলো ফেলা হয় নদীতে। মুহূর্তে আবার নদী থেকে তুলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাটিগুলোকে বালুতে পরিণত করা হয়।
এভাবে দস্যুরা তাদের বালু ব্যবসা চালিয়ে গেলেও শত শত একর জমি চাষাবাদের উপযোগিতা হারাচ্ছে। এছাড়া সম্প্রতি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া অংশে তীলক চর এলাকায় নির্মিত আশ্রায়ন প্রকল্প ভাঙ্গনের চরম হুমকির মধ্যে রয়েছে। এখানকার ফসলি জমি কেটে নেয়ার কারণে আশ্রায়ন প্রকল্পের বাসিন্দারা নিয়মিত নদী পাড়ে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ আর আহাজারি করছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
তবে গত ৩ এপ্রিল ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী। এসময় স্থানীয় ভূক্তভোগী লোকজন সরকারি এ কর্মকর্তাকে বালুদস্যুদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ তুলে ধরে। এসময় তাঁর সাথে ছিলেন, মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহফুজা জেরিন ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মিজানুর রহমান।
এসময় ভূক্তভোগীরা অভিযোগ করে, এলাকার কৃষকরা কথিত বালু সিন্ডিকেটের কাছে জমির মাটি বিক্রি করতে না চাইলে পাশের জমি কেটে তাদের বাধ্য করা হয়। তাতেও বিক্রি না করতে চাইলে বরণ করতে হয় ভয়ংকর পরিণতি। আবার কোন বিনিময় ছাড়া কৃষিজমির মাটি ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগও আছে।
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার সোনাপুর ও তীলকচর এলাকার বাসিন্দা আলী নেওয়াজ, আলমগীর হোসেন, ছগির আলী ও মিজানুর রহমান জানান, বালু মহাল সিন্ডিকেটের লোকজন প্রতিবছর সোনাপুরের শত শত একর কৃষিজমি কেটে নদীতে ফেলে তা থেকে বালু আহরণ করছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এ নিয়ে গ্রামবাসী প্রতিবাদ করলে তারা গ্রামের লোকজনের ওপর হামলার চেষ্টা করে। মিরসরাই এলাকা থেকে সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে গুরি ছোঁড়ে।
মিরসরাইয়ের ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা করেরহাট ইউনিয়নের অলিনগর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল আরো ভয়ংকর দৃশ্য। কাটতে কাটতে সেখানে আর কৃষিজমি বলতে কিছু নেই। বর্তমানে গ্রামের বাড়ি-ঘর, চলাচলের রাস্তা নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। তবুও বালু উত্তোলন থেমে নেই। কৃষিজমির মাটি কাটতে কাটতে কেটে ফেলা হচ্ছে নদীর পাড়ও!
জসিম উদ্দিন, ইরান ও জহুরুল ইসলামসহ উপস্থিত গ্রামবাসী জানান, গত কয়েক বছর গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের জিম্মি করে নামমাত্র টাকার বিনিময়ে কৃষিজমি কেটে বালু বানিয়ে তারা (বালুদস্যু সিন্ডিকেট) বিক্রি করে দিয়েছে। বর্তমানে নদী পাড়ে আর কৃষি জমির অস্তিত্ব নেই। এখন নদীর পাড় কেটে তারা বিক্রি করছে।
অলিনগর গ্রামের লিচু বাগান এলাকার ফিরোজা আক্তার নামের এক নারী অভিযোগ করেন, ‘নদীর পাড়ে এক শতক জায়গায় আমি আমার পরিবার নিয়ে থাকতাম। নদীর পাড় কেটে ফেলার কারণে তাও নদীর পেটে চলে গেছে। এখন আমি আমার পরিবার পরিজন নিয়ে করেরহাট বাজার এলাকার এক বাড়িতে আশ্রিতা হিসেবে জীবন-যাপন করছি।’
অবশ্য কথিত বৃহত্তর বালুমহাল সিন্ডিকেটের সভাপতি মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সোনা মিয়া এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা কৃষিজমি কাটছি না, এসব করছে ছাগলনাইয়া উপজেলার লোকজন। আমরা শুধুমাত্র নদী থেকে বালু আহরণ করছি।’ বালু সরবরাহের কাজে ভারী পরিবহণ চলাচলের কারণে এলাকার রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া এবং পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সম্পর্কে এই সিন্ডিকেট প্রধান বলেন, ‘এসবের কিছুই আমি জানি না।’
মিরসরাই উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মিজানুর রহমান নির্বিচারে বালু উত্তোলনের কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতির কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বেশ কয়েকদফা অভিযান চালিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধ করে সংশ্লিষ্টদের জরিমানাও করেছিলাম। আবার অভিযান চালাবো এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ অন্যদিকে, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে অসংখ্য বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অনেক ভিটেমাটি বিলীনের পথে।
তিনি বলেন, করেরহাট ইউনিয়নের জয়পুর পূর্বজোয়ার, পশ্চিম জোয়ার ও পশ্চিম অলিনগর, ধুম ইউনিয়নের পূর্ব মোবারকঘোনা ও পশ্চিম মোবারকঘোনা গ্রাম এলাকা বর্তমানে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে ভিটেবাড়ি হারানোর শংকায় রয়েছেন অনেকেই। আবার অনেকের ভিটে বাড়ি, ফসলী জমি গিলে ফেলেছে নদী। এখানকার অলিনগর ফরেষ্ট অফিস সড়ক, পশ্চিম অলিনগর বর্ডার সড়ক, পূর্বজোয়ার-জয়পুর সড়কের কিছু অংশ নদী গিলে খেয়েছে। এসব স্থানে সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রতিরক্ষা প্রকল্প দিয়েও রক্ষা করতে পারছে না সড়ক লোকালয়।
করেরহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনারা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলুন। আমরা এসব বন্ধে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি।’
স্থানীয় পশ্চিম অলিনগর গ্রামের বাসিন্দা হেদায়েত উল্যাহ বলেন, ‘একসময় ফেনী নদীর গভীরতা ছিল শুষ্ক মৌসুমে ৫ থেকে ৭ ফুট, বর্ষা মৌসুমে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ ফুট। বর্তমানে অতিরিক্ত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলনের কারণে ৭০ থেকে ৮০ ফুট গভীর হয়েছে নদী।’ গ্রামের চৌধুরী বাড়ির এই বাসিন্দা আশঙ্কা করেন, ফেনী নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে অলিনগর গ্রামটি মানচিত্র থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে।