বিচ্ছেদের প্রসঙ্গ এলেই সবার আগে একটা কথা মাথায় আসে একবিংশ শতাব্দীর কর্মজীবী নারীরা বিচ্ছেদের পথে বেশি হাঁটছেন। কিন্তু কেউ কেন ভাবছে না নারীরা কি বিশেষ কারণে এমন দলবেঁধে বিচ্ছেদ চাইছে?
একটা অঞ্চলে অপরাধ বেড়ে গেলে আমাদের বলা উচিত ওই অঞ্চলে অপরাধীর সংখ্যা বেড়ে গেছে, কিন্তু আমরা তা না বলে বলছি ওই অঞ্চলে অপরাধীদের নিয়ে অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
বিচ্ছেদের পথে নারীরা বেশি হাঁটছেন তার মানে কি এই যে বিচ্ছেদের পেছনে নারীর ভূমিকা বেশি? পুরুষ সম্পর্কে অবহেলা করবে এতে নারী বিচ্ছেদের পথে হাঁটলে সে দায় কি নারীর? আমি বলছি না নারীর ভূমিকা নেই তবে এর পেছনে পুরুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকাগুলো কেন সবসময় অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে!
শহরের নারীরা এখন অধিকাংশই চাকরীজীবী ও আত্মনির্ভরশীল এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এই ভয়াবহ সময়টাতে পুরুষের বিবাহের ক্ষেত্রে পছন্দের শীর্ষে রয়েছে কর্মজীবী নারী। মাস শেষে মোটা টাকা সংসারে আনে নারীরা। তবে তারা চান নারীরা সংসার, সন্তান কিংবা অফিস, ঘরে-বাইরে সমান তালে সব সামলাবেন।
কর্মজীবী একজন নারীর জন্য পুরুষেরও যে একটু বাড়তি সুবিধা, বাড়তি যত্নের প্রয়োজন আছে তা কখনোই একজন পুরুষ ভাবতে চান না, দায়িত্ব পালনের কথাতে অনেকদূর।
নারীরা ঘরে-বাইরে সমানভাবে কাজ করার জন্য যুদ্ধ করছেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই শুনতে হয় সংসারে মন নেই নারীর, কিন্তু সংসার কী নারীর একার? সারা দিন অফিসের ব্যস্ততায় ছুটোছুটির পর অনেকেই নারীর দিকে উড়নচণ্ডী বলে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, সারা দিনের অফিস শেষে পুরুষ বাসায় এলে তার জন্য যেমন বাড়তি যত্নের আয়োজন সাজিয়ে বসে থাকা হয় কজন অফিসফেরত নারী এ আয়োজন পান?
বিচ্ছেদ হওয়া বেশ কিছু পরিবারের ঘটনা পর্যালোচনা করে জানা গেছে, বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে নারী বা পুরুষের পরকীয়া বা সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় কারও প্রবেশের ফলে বিচ্ছেদের চেয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়াহীনতাই বিচ্ছেদের জন্য অনেক বেশি দায়ী।
এখনকার পুরুষদের প্রথম পছন্দ পশ্চিমা দেশের মতো আধুনিক, কর্মজীবী নারীরা কিন্তু আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে তাকে হতে হবে আশির দশকের আমাদের নানি-দাদিদের মতো পরিবারের প্রতি সব দায়িত্ব কর্তব্যে বদ্ধপরিকর এবং গৃহকর্মে নিপুণা। একই সঙ্গে দুদিকে অনন্য হওয়া একজন নারীর জন্য আদৌও কি সম্ভব!
নারীদের কাজে যেমন পরিবর্তন এসেছে একইভাবে পুরুষের কাজেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। তাদের মধ্যে এই মানসিকতার উন্নয়ন ঘটানো দরকার। যে খাবার প্রস্তুত করা কেবলই নারীর কাজ নয় বরং এটা জীবন ধারণের জন্য অতি দরকারি একটা কাজ। যে কাজের জন্য কোনো নির্দিষ্ট লিঙ্গের মানুষ হওয়ার প্রয়োজন নেই। যে কারও নিজের প্রয়োজনে খাবার প্রস্তুত করে করে খেতে পারার সক্ষমতা অর্জন করা উচিত, স্ত্রী আজ অফিস থেকে দেরিতে ফিরলে সেদিন স্বামী রান্না ঘরের চৌকাঠ অতিক্রম করলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। সন্তানের ভেজা ন্যাপকিন পরিবর্তন করা শুধুই মায়ের দায়িত্ব না, বরং এটি পিতা-মাতা নির্বিশেষে সদ্য পৃথিবীতে আসা নিজ কাজে অক্ষম শিশুটির প্রতি প্রত্যেক অভিভাবকের কর্তব্য।
রাতের বেলা সন্তান কাঁদলে মাকেই কেন সবসময় ঘুম থেকে উঠে সন্তানের কান্না থামাতে এ-ঘর থেকে ও-ঘর পায়চারি করতে হবে? কারণ বাবা যে সকালে অফিস যাবেন কিন্তু সকালে কি মা সংসার, সন্তান এক পাশে ফেলে পরে পরে ঘুমবেন? মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকা সি-সেকশনের যন্ত্রণা নিয়ে মাকেও তো ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংসারের অন্য কাজগুলো করতে হবে, তা হলে কেন রাতে কান্নারত শিশুকে সামলানো দায়িত্ব শুধুই মায়ের।
একটা শিশু পৃথিবীতে এলেই একজন নারী মা হোন। কিন্তু একজন পুরুষ পিতা হোন যখন ওই শিশু বাবা বলে ডাকতে শেখে। কর্মজীবী নারীদের বিবাহবিচ্ছেদ ঠেকাতে পুরুষদেরও সন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বাবার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। মায়ের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা এবং সংসারের খেয়াল রাখা শুরু করতে হবে। আমাদের কর্মজীবী নারীদের প্রতি আরেকটু নমনীয় কি আমরা হতে পারি না।
শিক্ষাথী, ইসলামিক স্ট্যাডিস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়