বৃহস্পতিবার- ২৭ মার্চ, ২০২৫

বিপিসিতে চাকরির পর সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এটিএম সেলিম

print news

চাকরিতে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ। যোগদানের পর থেকে শুরু বেপরোয়া দুর্নীতি। এরই মধ্যে গড়েছেন স¤পদের পাহাড়। এ নিয়ে অভিযোগ গড়িয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পর্যন্ত। যার ভিত্তিতে বিপিসির (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) হিসাব বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এটিএম সেলিমের বেপরোয়া দুর্নীতির তথ্য সামনে আসে।

আর দুর্নীতির এই অভিযোগ তদন্ত না করতে দুদকের অসাধু কর্মকর্তাদের দিয়ে যাচ্ছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। ফলে অভিযোগ দায়েরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও এই অভিযোগ তদন্তে কোন ব্যবস্থা নেয়নি দুদক। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে এই প্রতিবেদককেও অত্যন্ত সুকৌশলে বিভিন্ন পত্রিকায় কর্মরত প্রভাবশালী সাংবাদিকের ভয় দেখান এটিএম সেলিম। একই সাথে দূর্নীতির অভিযোগের ছিটেফোটাও সত্য নয় বলে দাবি করেন তিনি।

দুদকে দেওয়া অভিযোগের বিবরণে বলা হয়েছে, জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পরীক্ষা ছাড়াই বিপিসিতে চাকরি পান এটিএম সেলিম। ১৯৯৯ সালে ৪ জন সহকারী ব্যবস্থাপক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিপিসি। নিয়োগ বোর্ড হিসাব বিভাগে কাজী শহীদুর রহমান, বাণিজ্য বিভাগে আবুল কালাম আজাদ, এমআইএস বিভাগে মো. সোয়েব আহমেদকে ও পরিকল্পনা বিভাগে মো. মনিরুল ইসলাম নিয়োগ দেন

“এমন বেপরোয়া দূর্নীতিতে এটিএম সেলিম বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ফয়েস লেক আবাসিক এলাকায় হাজী আবদুল হামিদ রোডে ৬ তলা ভবন নির্মাণ করেন। ৭ কাঠা জমির উপর নির্মিত মনোরম ডিজাইনের ওই বাড়িটির নাম রাখা হয়েছে জ্যোৎস্না ভবন। স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে সেখানে থাকেন এটিএম সেলিম। অন্যান্য দুর্নীতিবাজদের মতো এটিএম সেলিমও বাড়িটি শ্বশুরের বলে প্রচার করে থাকেন। আর ভবনের নাম রেখেছেন শাশুড়ির নামে। প্রকৃত ঘটনা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা টাকায় নির্মাণ করা এ বাড়িটি হালাল করার জন্যই এই কৌশল নিয়েছেন এটিএম সেলিম। এই ভবনেই সপরিবারে থাকেন বিপিসির ওই কর্মকর্তা। স্থানীয়রা জানিয়েছে জমির কাগজ কার নামে রয়েছে বলা কঠিন তবে নির্মাণ থেকে সবকিছু করেছেন এটিএম সেলিম।

এছাড়া চান্দগাঁও থানার খালাসি লেকের বিপরীত দিকে ৪ ইউনিটের ৬ তলা বিশিষ্ট বিশাল একটি ভবনের মালিক তিনি। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র চকবাজারের একটি মার্কেটে ইডিইএস নামের একটি কাপড়ের দোকান (দ্বিতীয় তলায় দোকান নম্বর#২২) রয়েছে। যেটি তার স্ত্রী ও আপন ছোট ভাই দেখাশুনা করেন। যেটির বর্তমান মূল্য প্রায় কোটি টাকারও বেশি। যা তার আয়ের সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন অভিজাত মার্কেটে রয়েছে নামে বেনামে একাধিক দোকান।”

নিয়োগ পাওয়ার ৩ মাসের মাথায় মো. মনিরুল ইসলাম চাকরি ছেড়ে পূর্বের কর্মস্থল সিলেট গ্যাস ফিল্ডে যোগদান করেন। এতে একটি সহকারী ব্যবস্থাপক পদ শূন্য হয়ে পড়ে। তখন বিপিসির কো¤পানি সচিব ছিলেন এটিএম সেলিমের চাচা কামাল উদ্দিন। তার চাচা কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ও আইন না মেনে বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ বোর্ড কিংবা প্যানেল ছাড়াই অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে জালিয়াতির মাধ্যমে শূন্য হয়ে পড়া সহকারী ব্যবস্থাপক পদে এটিএম সেলিমকে নিয়োগ দেন।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, এটিএম সেলিমের সার্বিক তত্ত্বাবধানে মংলা অয়েল ইনস্টলেশন প্রকল্পের পরতে পরতে দুর্নীতির ছাপ বিদ্যমান। ঠিকাদারের বিলসহ সব পেমেন্ট দেওয়া হয় বিপিসির হিসাব বিভাগ থেকে। প্রকল্পের শুরুতেই শূন্য শতাংশ অগ্রগতিকে ৫০শতাংশ অগ্রগতি দেখিয়ে ম্যাক্সওয়েল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস ও পাইপলাইন লিমিটেডকে বিল দেওয়ার মতো জালিয়াতি উঠে এসেছে অডিট রিপোর্টে।

প্রকল্পটির আরডিপিপির (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২০৫ কোটি ৪৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। খরচ করা হয়েছে ২০৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এ কারণে অডিট প্রতিষ্ঠান খান ওয়াহাব শফিক রহমান এন্ড কো¤পানি ২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আপত্তি দিয়ে রেখেছে। প্রকল্পটির বেশ কিছু ভাউচারের হদিস পায়নি অডিটর। ভাউচারের বিষয়ে অডিট প্রতিষ্ঠান আপত্তি উত্থাপন করলে প্রকল্প পরিচালক (মোছাদ্দেক হোসেন) তার বক্তব্যে বলেছেন বিপিসির হিসাব বিভাগ থেকে বিল প্রদান করা হয়। তাই বিপিসির কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। পরে হিসাব বিভাগেও ভাউচার খুঁজে পায়নি অডিট প্রতিষ্ঠান।

এদিকে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার বছর পার না হতেই অফিস ও আবাসিক ভবনের প্লাস্টারে শ্যাওলা জমে। বেশ কয়েকটি ভবনের বারান্দায় ফাটল ধরেছে। সিড়ির রেলিং স্টেইনলেস স্টিলের দেওয়ার কথা থাকলে তা দেওয়া হয়নি, মরিচা ধরে বিবর্ণ আকার ধারণ করেছে রেলিং। কারসাজির কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এসবের মূলে আছেন এটিএম সেলিম।

bpc atm salim 1
চট্টগ্রামে এটিএম সেলিমের কোটি টাকার দুটি বাড়ি

দুদকের অভিযোগে আরো বলা হয়, বিপিসির অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারী লিমিটেডের এসপিএম (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) প্রকল্পে জমি অধিযাচনে দুর্নীতি ও লুটপাটের বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। ধান ক্ষেতের একর প্রতি মূল্য ৩ লাখ, আর পানের বরজের মূল্য ৬৩ লাখ নির্ধারণ করে জমি অধিযাচনের সিদ্ধান্ত হয়। অথচ এসপিএম প্রকল্পে যারা এটিএম সেলিমকে টাকা দিয়েছেন তাদের ধান ক্ষেতকে দেখানো হয়েছে পানের বরজ, আবার যারা টাকা দেননি তাদের পানের বরজকে ধান ক্ষেত দেখানো হয়েছে। এখানে প্রায় ৯৬ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকার দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে খোদ দুদক। ২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ঘুষের টাকা ভাগাভাগির সময় ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ টাকাসহ ১ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তার সূত্র ধরেই এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধানে দুর্নীতির ঘটনা উঠে আসে। যদিও এর মূল হোতা এটিএম সেলিম রয়ে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

বিপিসির রন্দ্রে রন্দ্রে থাকা দুর্নীতি বন্ধে অটোমেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া থামিয়ে রেখেছে এটিএম সেলিম চক্র। অটোমেশন হলে দুর্নীতি লুটপাট অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যেতো। বিশেষ করে তেল বিক্রি ও মজুদ এক ক্লিকেই দেখা যেতো। তাতে করে অধীনস্থ কো¤পানিগুলো (পদ্মা, মেঘনা, যমুনা) ব্যাংকে টাকা ফেলে রেখে ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে পারত না। স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলে এই ধরণের একটি বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। বিপিসি ওই কোম্পানিটির শেয়ার হোল্ডার। আর বিপিসির পক্ষ থেকে তদারকি করতেন এটিএম সেলিম নিজে। প্রায় ৩০০ কোটি টাকা লোকসান হয় টাকা নির্ধারিত সময়ে আদায় না করায়। ওই ঘটনায় মামলা হলেও মূল হোতা এটিএম সেলিম রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিস্তারিত দুদক অনুসন্ধান করলেই বেরিয়ে আসবে

সরকার যখন জ্বালানি সাশ্রয়ের কথা বলছে, তখনও বেপরোয়া এটিএম সেলিম। অফিসের গাড়িটি সারাদিন পারিবারিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। সকালে তাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় ছেলে-মেয়েকে স্কুলে আনা নেওয়ার জন্য। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েটি কখনও চট্টগ্রাম ক্লাবে, কখনও র‌্যাডিসন হোটেলে সাঁতার কাটতে যায়। বিগত কয়েকমাস মাস ধরে চলছে সেই রুটিন। মেয়ের সাতার শেখার ফাঁকে স্ত্রীকে দোকানে আনা নেওয়া করে এ গাড়ি। গাড়ির মাইল মিটার চেক করলেই এসব ধরা পড়বে।

নিজের পকেট ভারি করতে এটিএম সেলিম রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিপিসিকে ঠেলে দিয়েছে লোকসানের দিকে। ব্যাংকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আমানত থাকা অবস্থায় (এসএনডি ও এফডিআর) প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন ব্যাংক ঋণ নিয়ে। এতে দেখা গেছে, আমানতের বিপরীতে প্রাপ্ত সুদের চেয়ে ঋণের বিপরীতে পরিশোধিত সুদের পরিমাণ ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ ঋণ না নিয়ে নিজেদের আমানত থেকে বিপিসির একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে ২৭৮ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। সবকিছু জেনেও শুধু নিজের মুনাফার ধান্দায় সেই কাজটি করে বিপিসিকে ডুবিয়েছেন এটিএম সেলিম।

এই দুর্নীতির বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি। গত বছর ২৩ আগস্ট বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি আসম ফিরোজ সাংবাদিকদের বলেন, বিপিসিতে অনেক ঘাটতি রয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কম। তাদের অনিয়মের চিত্র দেখে কমিটি শকড (স্তম্ভিত)। বিভিন্ন কেনাকাটা ও নিরীক্ষায় যেসব আপত্তি এসেছে, তাদের সেগুলো সমন্বয় করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা কিছুই করেনি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অনেকের নাম উল্লেখ করে ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছিল। কিন্তু বিপিসি কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, দুদকের কথাও শোনেনি।

এমন বেপরোয়া দূর্নীতিতে এটিএম সেলিম বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ফয়েস লেক আবাসিক এলাকায় হাজী আবদুল হামিদ রোডে ৬ তলা ভবন নির্মাণ করেন। ৭ কাঠা জমির উপর নির্মিত মনোরম ডিজাইনের ওই বাড়িটির নাম রাখা হয়েছে জ্যোৎস্না ভবন। স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে সেখানে থাকেন এটিএম সেলিম। অন্যান্য দুর্নীতিবাজদের মতো এটিএম সেলিমও বাড়িটি শ্বশুরের বলে প্রচার করে থাকেন। আর ভবনের নাম রেখেছেন শাশুড়ির নামে। প্রকৃত ঘটনা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা টাকায় নির্মাণ করা এ বাড়িটি হালাল করার জন্যই এই কৌশল নিয়েছেন এটিএম সেলিম। এই ভবনেই সপরিবারে থাকেন বিপিসির ওই কর্মকর্তা। স্থানীয়রা জানিয়েছে জমির কাগজ কার নামে রয়েছে বলা কঠিন তবে নির্মাণ থেকে সবকিছু করেছেন এটিএম সেলিম।

এছাড়া চান্দগাঁও থানার খালাসি লেকের বিপরীত দিকে ৪ ইউনিটের ৬ তলা বিশিষ্ট বিশাল একটি ভবনের মালিক তিনি। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র চকবাজারের একটি মার্কেটে ইডিইএস নামের একটি কাপড়ের দোকান (দ্বিতীয় তলায় দোকান নম্বর#২২) রয়েছে। যেটি তার স্ত্রী ও আপন ছোট ভাই দেখাশুনা করেন। যেটির বর্তমান মূল্য প্রায় কোটি টাকারও বেশি। যা তার আয়ের সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন অভিজাত মার্কেটে রয়েছে নামে বেনামে একাধিক দোকান।

শুধু চট্টগ্রাম নয়, দুর্নীতির টাকায় এটিএম সেলিমের সম্পদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন রাজধানী ঢাকাতেও। ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানীতেও নামে বেনামে একাধিক ফ্ল্যাট কিনেছেন এটিএম সেলিম। এছাড়া অস্ট্রেলিয়াতে বন্ধু আবদুল করিমের কাছে টাকা পাচার করে কিনেছেন বাড়ি। গড়ে তোলেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

এ বিষয়ে এই প্রতিবেদকের মুখোমুখি হন এটিএম সেলিম। অভিযোগের কথা শুনে তিনি বলেন, জোৎস্না ভবন আমার শ্বশুরবাড়ি। এই ভবনের চার তলায় আমি পরিবার নিয়ে থাকি। আমার শ্বশুড় মেয়ের নামে চতুর্থ তলা হেবা করেছেন। এতে আমার কোন বিনিয়োগ নেই। আর চান্দগাঁও খালাসি লেকে আমার কোন ভবন নেই। যদি থাকে বাহির করেন। আমি আপনার নামে লিখে দেব।

তিনি বলেন, দুদকের কাছে করা অভিযোগের একটি তথ্যও সত্য নয়। সে কারণে আমি দুদক নিয়ে কোন টেনশন করি না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বছর পার হলেও দুদক এ নিয়ে কোন তথ্য আমার কাছে জানতে চাইনি। সেটা অবশ্যই তাদের ব্যাপার। দুদকও কতটুকু ভাল সেটা তো আপনারা ভালো জানেন।

ঈশান/মউ/মখ

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page