বুধবার- ২৬ মার্চ, ২০২৫

বিলুপ্তির পথে চবির শাটল ট্রেনের ঐতিহ্য

print news

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটল ট্রেনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০ সালে। এরপর থেকেই এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম। যদিও এ ট্রেনে চড়ে আসা যাওয়া করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের আরও দুই উপজেলার অসংখ্য মানুষ।

শিক্ষার্থীরা জানান, প্রতিদিন সকালে চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর বটতলী স্টেশন থেকে ১০ বগির এক জোড়া শাটল ক্যা¤পাসে উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। শাটল ট্রেনের প্রতিটি বগির রয়েছে আলাদা আলাদা নাম। এগুলো চবির এক সময়ের বগিবাজ শিক্ষার্থীদের দেওয়া।

নামগুলো হচ্ছে-দোস্ত, ককপিট, অলওয়েজ, অক্টোপাস, সিক্সটি নাইন, একাকার, ফাইট ক্লাব, ফাটাফাটি, ভিএক্স, সিএফসি, উল্কা, এফিটাফ, বিজয়। এ সময় বগিগুলো ছিল শিল্পের কারুকাজে রঙচঙা। পরে রঙচঙা বগিগুলোও হারিয়ে যায়। তবে করোনাকালীন সময়ের আগে এসব বগি ফের জার্মান শিক্ষার্থীদের রংয়ে রঙিন হয়ে উঠে।

শিক্ষার্থীরা আরও জানান, এসব বগিভিত্তিক সংগঠন থেকে তখন উঠে আসতো ছাত্র রাজনীতির নতুন মুখ। তবে সংঘাত-সংঘর্ষের কারণে ২০১৫ সালের দিকে চবিতে বগিভিত্তিক সংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরপর এসব সংগঠন ক্যা¤পাসে থাকলেও শাটলের বগি থেকে এখন প্রায় বিচ্ছিন্ন।

তবুও এই শাটলে যাতায়াতের মাধ্যমে এখানকার শিক্ষার্থীদের মাঝে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। কখনো এটি গড়ায় প্রণয়ে। এখানেই ভাগাভাগি হয় জীবনের সংকটের কথা, হয় আড্ডা, খুনসুটি। তবে শাটল ট্রেনের অন্যতম আকর্ষণ হলো শাটলের গান।

ক্যা¤পাসে আসা যাওয়ার পথে শাটলে অনেকেই গান করেন। এই ট্রেন ভ্রমণে তৈরি হয় মৌলিক অনেক গান। প্রতিদিন ক্যা¤পাসে শাটলে করে আসা-যাওয়ার পথে গানে গানে মাতিয়ে রাখে প্রতিটি বগির শিল্পীরা। কখনো সুরের তালে আবার কখনো ছন্দহীন সুরের আঁকাবাঁকা তালে। সুর-বেসুরের এই গানের ভেলায় মেতে উঠে শিক্ষার্থীরাও।

শাটল ট্রেনের বগির পাটাতন শিক্ষার্থীদের বাদ্যযন্ত্র। বগির পাটাতন পিটিয়ে, শিষ বাজিয়ে গানের সুর তুলতেন শিক্ষার্থীরা। দেশের বেশ কয়েকজন তারকা শিল্পী গড়ে উঠেছেন এই শাটলকে ঘিরে। নকিব খান, পার্থ বড়ুয়া, এস আই টুটুলের মতো শিল্পীরা এই শাটলের হাত ধরেই উঠে এসেছেন।

একটা সময় শাটলের গান শিক্ষার্থীদের যাতায়াতকে করতো মধুময়। ওসব গানের কথা, সুরে খুঁজে পাওয়া যেত প্রাণ। আবেগ জড়ানো সুরে ভাওয়াইয়া, দেশাত্ববোধক, বাউল, নজরুল, রবীন্দ্র, হিন্দি, ইংরেজি গানে শাটলের বগিগুলো যেন একেকটা শিল্পীর মঞ্চ।

বর্তমানে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে শাটলের গানে। এখন আর আগের মতো ট্রেনের বগির পাটাতন পিটিয়ে গানের সুর পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে। শাটলের গানের মধ্যে আর প্রাণই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো শাটলে উঠা নিয়ে চিন্তিত থাকেন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের মতে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ২৭ হাজার শিক্ষার্থীছাড়াও হাটহাজারী-ফটিকছড়ি উপজেলার অসংখ্য মানুষের যাতায়াতের বাহন শাটল ট্রেন। ফলে ট্রেনের বগিতে স্থান সংকুলান এখন দূরূহ ব্যাপার। বগি সংকট, অপর্যাপ্ত শিডিউল ও সংস্কারের অভাবে ভোগান্তির বস্তুতে পরিণত হয়েছে এখন শাটল ট্রেন।

ঠিক এমন পরিস্থিতিতে গত ৭ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ৮টায় ভেতরে জায়গা না পেয়ে ছাদে চড়ে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পথে হাটহাজারী উপজেলার চৌধুরী হাট এলাকায় রেললাইনের পাশে ভেঙে পড়া গাছের ডালের সাথে আঘাত পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২৫ জন গুরুতর আহত হন।

পরবর্তীতে ট্রেনটি ফাতেয়াবাদ স্টেশনে থামলে আহতদের নিচে নামিয়ে আনেন অপর শিক্ষার্থীরা। এরপর আহতদের স্থানীয় ক্লিনিক ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান তারা। এর মধ্যে চবির তিন শিক্ষার্থীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিটে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে।

তারা এখন লাইফ সাপোর্টে আছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা হলেন- আমজাদ হোসেন সোহাগ (১৮), খলিলুর রহমান (২২) এবং অংসইনু মারমা (২১)। এছাড়া ৫ জন নিউরো সার্জারী ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন। তারা হলেন-তাইজুল ইসলাম (২১), আবু সাইদ (২৪), সান আহমেদ (২১), রাফসান (২৩) ও আসলাম (২২)। তবে অন্য একটি অসমর্থিত খবরে বলা হচ্ছে-আমজাদ হোসেন সোহাগ ও খলিলুর রহমান চবির শিক্ষার্থী নন।

চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল আলম আশেক সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে শাটল দুর্ঘটনায় আহত মোট ১৬ জনকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আটজনকে নিউরো সার্জারী ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। অপর আটজন ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে ভর্তি করা হয়। তবে নিউরো সার্জারী বিভাগে ভর্তি হওয়া ৮ জনের মধ্যে তিনজনকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাদের অবস্থা গুরুতর।

এ ঘটনায় শিক্ষার্থীরা ওই রাতেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায়ী করে ক্যাম্পাসে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এ সময় বিক্ষুব্দ শিক্ষার্থীরা জিরো পয়েন্টে অবস্থিত পুলিশ বক্সে ভাঙচুর চালায়। এমনকি উপাচার্যের বাসভবন, পরিবহন দপ্তরের যানবাহনে ও শিক্ষক ক্লাবে ভাঙচুর চালায়। এর আগে শিক্ষার্থীরা শাটল ট্রেনের চালকদেরও মারধর করে।

এ ঘটনায় একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। অন্যদিকে শাটল ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় রেলওয়ে রানিং স্টাফ শ্রমিক কর্মচারী সমিতি। নিরাপত্তার অজুহাতে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় তারা। তবে গত রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তির আওতায় আনার আশ্বাসে ট্রেন চালাতে সম্মত হন রানিং স্টাফ শ্রমিক কর্মচারি সমিতি।

শিক্ষার্থীদের অভিমত, চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিমি দূরে পাহাড় ও সবুজে ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে আসা সর্বশেষ শাটল ট্রেন চট্টগ্রাম শহরের বটতলী স্টেশন থেকে রাত সাড়ে আটটায় ছেড়ে আসে। এই সময়ের ট্রেনে ভীড় হয় অতিরিক্ত সীট না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী, অনেক সময় আবার দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও মেলা ভার। অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করেন শাটলের ছাদে চড়ে।

বটতলী স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন ষোলশহর স্টেশনে পৌছালে সেখানে আগে থেকে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় সীট ধরার। চলন্ত ট্রেনে তাই অনেকেই দৌড়ে উঠতে চেষ্টা করেন। অসতর্কতা ও তীব্র ভীড়ের মধ্যে অনেক সময় দূর্ঘটনার শিকার হন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, একে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জায়গা হয় না, তার মধ্যে বহিরাগতরাও উঠে পড়েন শাটলে। আবার আলো সল্পতার কারণে বহিরাগত বখাটের দ্বারা হেনস্তার শিকার হন নারী শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া মাঝেমধ্যেই শাটলে পকেটমার ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তীব্র তাপদাহের মধ্যেও চলে না ফ্যান। ফলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে যান। এভাবে দিন দিন দুর্ভোগের নাম হয়ে উঠছে শাটল। হারাচ্ছে ঐতিহ্য। গর্বের শাটলের এসব কলঙ্ক মুছতে দ্রুত শাটল সংস্কার ও শিডিউল বাড়ানোর দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।

শাটলে গান হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। তম্মধ্যে বিশ্বদ্যিালয়ের ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আরিফুজ্জামান বলেন, আগে বগিভিত্তিক সুবিধার কারনে সবাই এক হয়ে গান করার সুবিধা পেতো। এখন সবাই এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাই আমি মনে করি অন্তত পক্ষে বগির শেষ দিকটা গানের জন্য (যারা গান গায়) তাদের জন্য উন্মুক্ত করা উচিত। আমি চাই শাটলের যে পুরনো ঐতিহ্য রয়েছে সেটা ফিরে আসুক।

একই কথা বললেন অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সুদিপ্ত পাল। তিনি বগিতে অনেকবার গান করেছেন। তিনি বলেন, আসলে মূল ব্যাপার হলো যে শাটলে কেউ সিঙ্গেল গান করতে চায় না। গ্রুপ সঙ্গিতই বেশি জনপ্রিয়। বগি রাজনীতি থাকার সময়ে গ্রুপ মেম্বাররা একসঙ্গে যাতায়াত করতো। ফলে তারা গান করতো। তাদের দেখায় অন্যরাও সুর মেলাতো। বগি রাজনীতি উঠে যাওয়ার ফলে শাটলে গানের ট্রেন্ড কমে গেছে। গান এখনো হয় তবে আগের তুলনায় কম।

রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী তন্বী রুদ্র বলেন, আগে গ্রপ ভিত্তিক একসঙ্গে সুর মিলিয়ে গান হতো। এখন আর হয় না। কেউ কেউ একলা গান করতে চাই না। শাটলের গান না থাকায় শিক্ষার্থীরা এখন কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমি চাই শাটলের গান ফিরে আসুক।

চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরিণ আখতার এ প্রসঙ্গে বলেন, বগিভিত্তিক মারামারির কারণে একসময় বগিভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই কারণে শাটলের গান হবে না, তা কিন্তু কেউ বলেনি। শাটলে গান হয় না তাও কিন্তু ঠিক নয়। তবে বগি সংকটসহ নানা কারণে শাটলের ঐতিহ্য হারাচ্ছে। আর শাটল ট্রেনের ব্যাপারে আমরা রেলওয়েকে বলতে বলতে শেষ। এমনকি রেলওয়ে মন্ত্রী আমাদের গত বছরই বলেছিলেন ট্রেন দেবেন। তারা বলেছে তারা চেষ্টা করছে আরও দুই তিনটা বগি বাড়ানোর। কিন্তু আমরা এখনো ট্রেন পাইনি।

তিনি বলেন, শাটল ট্রেনের যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক, তারা আমাকে পর্যন্ত হামলার উদ্দেশ্যে উপাচার্য বাংলো ভাঙচুর করেছে। এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী করতে পারে না।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক আবিদুর রহমান বলেন, শাটলে বগি বাড়ানোর বিষয়ে কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে বগি সংকটের বিষয়টি আমাদের জানালে রেলের সাধ্যের মধ্যে সেটি করার চেষ্টা করা হবে। আর বগিতে আলোর স্বল্পতা আছে, এটা ঠিক নয়। তবে বগিতে কোন ফ্যান নেই। আর সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page