
ভারতকে দেয়া বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল আগে থেকেই। কারণ ট্রানজিটের যে ফিডারপোর্ট সেই চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের তেমন কোন সক্ষমতা নেই। এরপরও প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছা বলে কথা।
ফলে অনিহা তো দূরের কথা সংশ্লিষ্টরা এমন হাবভাব দেখিয়েছে যেন ট্রানজিটের মাধ্যমে দেশে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটতে শুরু করেছে। তবে গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাতে উৎখাত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। এতে এই ট্রানজিটের ভবিষ্যত নিয়ে নানা প্রশ্ন জোরালো হয়েছে। কারণ এই ট্রানজিটের পক্ষে নয় দেশের ৯৯% মানুষ। যার মূল্যায়ন করতে পারে নতুন অন্তবর্তিকালীন সরকার।
এমন তথ্য জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের সংশ্লিষ্টদের অনেকে। যাদের সঙ্গে কথা হয় গতকাল ১৪ আগস্ট বুধবার ও আজ ১৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার। যদিও তাদের অনেকেই নাম-পরিচয় প্রকাশে সাহস করেনি।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (পরিবহণ) এনামুল করিম বলেন, ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা, পথ নির্ধারণ, মাশুল নির্ধারণ, পরিচালনা নীতিমালা সবই হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন পথে পরীক্ষামূলক চালানও গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রানজিট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়নি। কোনো পথেই ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের চালান নিয়মিত হয়নি।
তিনি বলেন, গত ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ট্রানজিটের আটটি পথ নির্ধারণ করে মাশুল ঠিক করেছিল। এর মধ্যে ট্রানজিটের সর্বশেষ সংযোজন হলো, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভূখন্ড হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য আনা-নেওয়া করা। স্থায়ী আদেশও জারি করা হয়। কিন্তু এরপর এই পথে কোনো পণ্য আসা-যাওয়া করেনি। কারণ ট্রানজিটের জন্য পুরোপুরি সক্ষম নয় চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর।
একই কারণে ট্রানজিট নিয়ে ভারতের ব্যবসায়ীরাও খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। যদিও ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী সান্তনা চাকমা ব্যবসায়ীদের আগ্রহী করে তোলার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে চারটি পথে পণ্য আনা-নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এই পথ ব্যবহার করতে পারবেন।
ট্রানজিটে কেন আগ্রহ নেই জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শুধু অনুমোদন দিলেই তো হবে না। পণ্যের চালানের চলাচল মসৃণ করতে অবকাঠামো সুবিধা ও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে সেই সুবিধা তৈরী হয়নি।
তিনি বলেন, ভারতের বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য নিতে অবকাঠামো সুবিধাসহ খরচ ও সময় বিবেচনা করবেন। এছাড়া ভারতের ব্যবসায়ীরা চিকেন নেক দিয়ে পণ্য পরিবহন করলে পরিবহন খরচে বিশেষ ভর্তুকি সুবিধা পান। ওই পথে তাঁদের খরচ কম হলে বাংলাদেশ দিয়ে আসতে আগ্রহ দেখাবেন না।
এদিকে এনবিআর ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্রানজিটের পণ্যের চালানের সীমান্ত পাড়ি দিতে সব সুবিধাই নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন ভারতের ব্যবসায়ীদের ট্রানজিট ব্যবহার বাড়াতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা দরকার।
এনবিআর সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে চারটি স্থলবন্দর দিয়ে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্যের চালান নেওয়া যাবে। এই চার স্থলবন্দর হলো আখাউড়া, বিবিরবাজার, তামাবিল ও শেওলা। বন্দর দিয়ে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট হলে ডকুমেন্ট প্রসেসিং মাশুল প্রতি চালানে ৩০ টাকা, প্রতি টনে ট্রান্সশিপমেন্ট মাশুল ২০ টাকা, নিরাপত্তা চার্জ প্রতি কন্টেইনারে ৮৫ টাকা, প্রশাসনিক চার্জ প্রতি টনে ১০০ টাকা, কন্টেইনার স্ক্যানিং চার্জ ২৫৪ টাকা। এছাড়া সড়ক ব্যবহার মাশুল ও ইলেকট্রিক লক অ্যান্ড সিল মাশুলও আরোপিত হবে। প্রতিটি মাশুলের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাটও দিতে হবে।
এতকিছু হওয়ার পরও চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে সড়কপথে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য নেওয়ার উদ্যোগও আলোর মুখ দেখছে না। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রথম পরীক্ষামূলক চালান যায়। এরপর কয়েকটি চালান গেছে। গত বছর এপ্রিল মাসে এই দুই পথ নিয়মিত করা হয়। এরপর গত একবছর তিন মাসে একটি চালানও যায়নি।
এরপরও চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দরকে ভারতের পণ্যসামগ্রী পরিবহনে ট্রানজিট সুবিধায় উন্মুক্ত করে দেয়ার লক্ষ্যে তোড়জোড় চলছে। দুই বন্দরে ভারতের আমদানি ও রপ্তানিমুখী পণ্য অভ্যন্তরীণ নৌ, রেল ও সড়কপথে পরিবহনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আবার ট্রানজিট পণ্যের জন্য উভয় বন্দরে বিশেষ ইয়ার্ড ও শেড নির্দিষ্ট করে রাখা হতে পারে। ভারতও তা চেয়েছে।
কিন্তু দেশের আমদানি ও রপ্তানিমুখী পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিং করতে গিয়েই প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামের এবং অপর দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মোংলার বেহাল ও বেসামাল অবস্থা। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিবছর গড়ে ১২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে পণ্য হ্যান্ডলিং। কন্টেইনার ওঠানামা ২১ লাখ টিইইউএস অতিক্রম করতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বছরের বেশিরভাগ সময়ই উভয় বন্দর কন্টেইনারসহ কার্গোজটে স্থবির হয়ে পড়ে। কেননা দেশের আমদানি-রপ্তানির ক্রমবর্ধমান চাপ ও চাহিদা সামাল দিতে গিয়ে এর বিপরীতে ভৌত অবকাঠামো, সংকুলানের স্থান, যান্ত্রিক ও কারিগরি সুবিধার ক্ষেত্রে হিমসিম অবস্থা বিরাজ করছে। উভয় সমুদ্র বন্দরেরই প্রয়োজনীয় সক্ষমতার অনেকাংশেই অভাব রয়েছে। ভারতের পণ্য হ্যান্ডলিং করার জন্য আদৌ প্রস্তুত নয় দুটি বন্দর।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতমুখী পণ্যের ট্রানজিট চালুর লক্ষ্যে পরীক্ষামূলক ব্যবস্থায় সর্বপ্রথম পণ্য আনা-নেয়া শুরু হয় ২০১৫ সালে। ২০১৫ সালের ২ জুন এমভি ইরাবতী স্টার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩ নম্বর জেটিতে ভিড়ে এবং ভারতের তিনটি বন্দরগামী পণ্যভর্তি ৯২টি কন্টেইনার নামায়। এরপর ভারতের জন্য আনীত ৮৫টি কন্টেইনার নিয়ে ওই সালের ১৩ জুন চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করে এমভি ওশান প্রুব জাহাজটি। এসব কন্টেইনার ভারতের চেন্নাই ও নভোসেবা বন্দরে পৌঁছে। ভারতের চেন্নাই, কোচিন ও নভোসেবা বন্দরে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে কন্টেইনারগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়েছিল।
চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করে ভারতের পণ্য পরিবহনের এই ট্রানজিট অথবা করিডোর ব্যবস্থাকে তখন দু‘দেশের সরকারি তরফ থেকে অভিহিত করা হয় ট্রান্সশিপমেন্ট কিংবা কানেকটিভিটির নামে। ২০১৫ সালের ৬ ও ৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে ভারত কর্তৃক চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক এবং উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে ভারতকে এ ধরনের ট্রানজিট, করিডোর কিংবা ট্রান্সশিপমেন্ট, কানেকটিভিটি সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে কোন নিয়মিত চুক্তি ইতোপূর্বে হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দরে সমুদ্রগামী মার্চেন্ট জাহাজ আসা-যাওয়া করে বছরে সোয়া ২ হাজারেরও বেশি। অন্তত সাড়ে ৬ কোটি মেট্রিক টন আমদানি ও রপ্তানি পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিং (খালাস, মজুদ ও শিপমেন্ট) হয়ে থাকে। এই বাবদ বছরে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ রাজস্ব আয় এবং ট্যারিফ, ফি বা মাসুল আহরিত হচ্ছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর সমগ্র দেশের বিশাল অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি।
চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধায় জাহাজযোগে পণ্যসামগ্রী পরিবহনের সুযোগ-সুবিধা চেয়ে দীর্ঘদিন যাবত পীড়াপীড়ি করে আসছে ভারত। বিষয়টি এতোকাল আলোচনা-পর্যালোচনার টেবিলে সীমাবদ্ধ থাকলেও ট্রানজিটের বিষয়টি শিগগিরই বাস্তব রূপ দেয়া হচ্ছে। তবে দেশের বন্দর ও কাস্টমস ভারতের ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট বাবদ ফি, চার্জ, মাশুল, শুল্ক-কর প্রাপ্তির বিষয়টিও এখন পর্যন্ত অস¤পূর্ণ রয়েছে। সরকারিভাবে তা চূড়ান্ত হয়নি। যদিও ট্রানজিট বাবদ ভারত থেকে বড় ধরনের কোন মাসুল পাওয়ার প্রত্যাশা ক্ষীণ হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই।
বন্দর ব্যবহারকারী তথা স্টেকহোল্ডাররা জানান, চট্টগ্রাম দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর। ভারতের ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের জাহাজ ও পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিংয়ের বাড়তি চাপ নেয়ার মতো সক্ষমতা চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের নেই। এ ক্ষেত্রে বন্দরের সবধরনের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দেশের সড়ক-মহাসড়ক, রেলওয়ে ব্যবস্থাও ট্রানজিটের জন্য অত্যন্ত অপর্যাপ্ত।
দেশের পণ্য পরিবহনের ভার সামাল দেয়ার জন্য আগে চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধাসমূহ সম্প্রসারণের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। তাছাড়া ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্টের প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে কি পড়বে, অর্থাৎ ট্রানজিটের লাভ আগেই গভীরভাবে খতিয়ে দেখা ও সময়মতো সুবিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজনীয় গাইডলাইন ও সুষ্ঠু নীতিমালাও তৈরি করতে হবে। উপরন্তু ভারতকে ট্রানজিট দেয়া না দেয়ার প্রশ্নে চট্টগ্রাম বন্দরের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতকে উপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিৎ।
আশুগঞ্জ নৌ-বন্দর ব্যবহারের পর থেকেই চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দরকে কানেকটিভিটি কিংবা ট্রান্সশিপমেন্টের নামে ট্রানজিট সুবিধায় পেতে জোরালোভাবে পীড়াপীড়ি করে আসছে ভারত। ২০১৫ সালের ৬-৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় এ বিষয়টি ভারত সরাসরি আলোচনার টেবিলে তুলে আনে। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
বন্দর ট্রানজিটের পেছনে ভারতের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভূমি পরিবেষ্টিত (ল্যান্ড লকড) দি সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭টি রাজ্যে (ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, অরুনাচল, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও মনিপুর) পণ্য পরিবহন নিশ্চিত করা। ভারত চাইছে তার দীর্ঘ ঘুরপথের পরিবর্তে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে পণ্যসামগ্রী সহজপথে স্বল্প সময়ে উপরোক্ত ৭টি রাজ্যে নিয়ে যাওয়া। এর জন্য ভারতের বাসনা, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর এবং বাংলাদেশের সড়ক ও রেলপথকে ট্রানজিটের উন্মুক্ত সুবিধায় ব্যবহার করা। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম প্রধান রেল ও সড়ক রুটসহ দেশের সড়ক, মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়কগুলোও ট্রানজিটের ভার বহনের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। সীমিত সড়কগুলো ট্রানজিটে ব্যবহৃত হলে সমগ্র দেশের পরিবহন ব্যবস্থা আরও ভেঙে পড়বে।
দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর হিসেবে চট্টগ্রাম সমগ্র দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স¤পন্ন করে থাকে। এর জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি-বার্থ, ইয়ার্ড-শেড, গুদাম, অফডক, সড়কসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা মোটেই পর্যাপ্ত বা যথেষ্ট নয়। অপ্রতুলতা ও হরেক সীমাবদ্ধতার মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলেছে চট্টগ্রাম বন্দর। বঙ্গোপসাগর কোলে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় নিরাপদ পোতাশ্রয়কে ঘিরে হাজার বছর আগে গড়ে উঠে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর। বর্তমানে এটি একটি আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর হলেও চট্টগ্রাম হচ্ছে ফিডার পোর্ট।
অর্থাৎ স¤পূর্ণরূপে জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করে পরিচালিত হয় বন্দরে জাহাজ আসা ও যাওয়ার সিডিউল। দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দর বর্তমানে অনেকাংশেই কন্টেইনার-শিপিং বাণিজ্য নির্ভর হয়ে উঠেছে। বর্তমান সময়ে বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানিমুখী কন্টেইনার ওঠানামা, পরিবহন করা হচ্ছে বছরে ২১ লাখ ৮৯ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার (২০ ফুট সাইজের ইউনিট হিসাবে)। বছর বছর কন্টেইনার ওঠানামার প্রবৃদ্ধিও ব্যাপক। বর্তমানে ৪০ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার রাখা সম্ভব হচ্ছে বন্দরের ইয়ার্ডসমূহে। সামগ্রিকভাবে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরটি সমগ্র দেশের আমদানি-রপ্তানিমুখী পণ্য হ্যান্ডলিং ও পরিবহনের প্রয়োজন সামাল দিতে গিয়েই প্রতিনিয়ত চাপে রয়েছে। এ অবস্থায় প্রতিবেশী তাও ভারতের মতো বৃহৎ দেশের জন্য ট্রানজিট সুবিধা উন্মুক্ত করে দেয়ার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর এবং তার সাথে সংযুক্ত অবকাঠামো বাস্তবিক অবস্থাতেই অক্ষম।
এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে গত বছর কয়েকটি নতুন নৌপথ চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে একটি পথ হলো দাউদকান্দি থেকে গোমতী নদী দিয়ে কুমিল্লা হয়ে ত্রিপুরার সিপাইজলা জেলার সোনামুড়া পর্যন্ত নৌপথে; পরে সেখান থেকে সড়ক পথে আগরতলা। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে এই পথে পরীক্ষামূলকভাবে একটি সিমেন্টের চালান গেছে। কিন্তু নাব্যতাসংকট থাকায় এই পথে আর পণ্য নিতে আগ্রহ দেখাননি ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া সড়ক পথে বহুমাত্রিক ট্রানজিট চালু আছে। কলকাতা থেকে নৌপথে আশুগঞ্জ, পরে সড়ক পথে আখাউড়া হয়ে আগরতলা-এই হলো বহুমাত্রিক ট্রানজিটের পথ। ২০১১ সালে ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতি বিশেষ ব্যবস্থায় এই পথে নেওয়ার পর ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কয়েক বছরের দর-কষাকষি শেষে মাশুলসহ ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হয় ২০১৬ সালে। কিন্তু গত ৭ বছরে ২০-২৫টি চালান গেছে এই পথে। খুব একটা মাশুলও পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, কয়েক বছর আগেই কলকাতা থেকে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা পর্যন্ত রেলপথ চালু হয়ে গেছে। আগে ত্রিপুরার ধর্মনগর পর্যন্ত রেলপথ ছিল। এখন আগরতলা ছাড়িয়ে সাবরুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে কলকাতা থেকে রেলপথে সরাসরি আগরতলায় ভারী পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে একযোগে আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা বিবিআইএন নামে পরিচিত। বিবিআইএনের আওতায় ২০১৫ সালের জুন মাসে ভুটানের রাজধানী থি¤পুতে চার দেশের মধ্যে অবাধ মোটরযান চলাচল চুক্তি হয়। ভুটান ছাড়া সব দেশ তাতে অনাপত্তি দিয়েছে।
অবাধ মোটরযান চলাচল চুক্তির আওতায় পরীক্ষামূলক যাত্রা হিসেবে ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের ভূখন্ড হয়ে আখাউড়া দিয়ে আগরতলা যায় ভোডাফোন কো¤পানির যন্ত্রাংশের চালান। আলাদা কোনো মাশুল আরোপের সুযোগ না থাকায় প্রতীকী এক রুপি মাশুল আদায় করা হয়েছিল ওই সময়। এরপর আর কোনো চালান যায়নি।