বৃহস্পতিবার- ২৭ মার্চ, ২০২৫

ভারতে অন্তরীণ ৭৮ নাবিকের খাবার শেষ, উৎকণ্ঠায় স্বজনরা

print news

ঙ্গোপসাগরে মাছ আহরণের সময় ভারতীয় কোস্ট গার্ডের ধরে নিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ৭৮ নাবিক ও জেলেসহ দুটি মাছ ধরা ট্রলার এখনো ওডিশার প্যারাদ্বীপ উপকূলে নোঙর করা রয়েছে। ট্রলার দুটিতে যে খাবার ছিল, তা গত রোববার শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।

এ নিয়ে দুই ট্রলারের নাবিকদের স্বজনরা চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন। আটক অবস্থায় নাবিকরা কেমন আছেন, তাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হচ্ছে, কবে নাগাদ তারা ফিরতে পারবেন- এ নিয়ে স্বজনদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুস সাত্তার এবং আটক এফভি মেঘনা-৫ জাহাজের মালিক বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান সিঅ্যান্ডএ অ্যাগ্রো লিমিটেডের ম্যানেজার (অপারেশন) আনসারুল হক ১৬ ডিসেম্বর সোমবার দুপুরে এ তথ্য জানান।

তারা জানান, আটক নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে দ্বিপক্ষীয় কুটনৈতিক তৎপরতা চলছে। স্থানীয়ভাবে আটকদের খাবার সরবরাহ করার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশে আটক জেলেদের মুক্তির বিনিময়ে ৭৮ বাংলাদেশিকে ছেড়ে দেওয়ার শর্ত দিয়েছে ভারতীয় পক্ষ।

আনসারুল হক বলেন, বাংলাদেশে আটক ভারতীয় জেলেদের ছাড়িয়ে নিতে চাপের কৌশল হিসেবে ভারতীয় কোস্ট গার্ড বাংলাদেশি নাবিক ও জেলেদের ধরে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধভাবে মাছ ধরার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক ৯৫ জন ভারতীয় জেলে দেশের কারাগারে রয়েছেন। গত ১৪ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বরের মধ্যে তাঁদের আটক করা হয়।

গত ৯ ডিসেম্বর সোমবার সকাল ১০টার দিকে বঙ্গোপসাগরে খুলনায় হিরন পয়েন্ট এলাকা থেকে ট্রলার দুটি ভারতীয় কোস্টগার্ড সদস্যরা আটক করে নিয়ে যায়। ট্রলারগুলো হলো- এফভি লায়লা-২ ও এফবি মেঘনা-৫। এর মধ্যে এফভি লায়লা-২ এস আর ফিশিং নামে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন। এফভি মেঘনা-৫ চট্টগ্রামভিত্তিক সিঅ্যান্ডএ অ্যাগ্রো লিমিটেডের মালিকানাধীন।

দুই দিনের মাথায় মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) রাতে ভারতীয় কোস্টগার্ডের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে তিনটি ছবি প্রকাশ করে এ সংক্রান্ত বার্তা দেওয়া হয়। একটি ছবিতে নাবিকদের একটি ট্রলারের ডেকে মাথার পেছনে দু‘হাত রেখে হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকতে দেখা গেছে। আর দুটি ছবিতে ট্রলারগুলো দেখা গেছে।

ইন্ডিয়ান কোস্টগার্ড ফেসবুক পেইজে ছবি তিনটি প্রকাশ করে এ সংক্রান্ত পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতীয় সমুদ্রসীমায় মৎস্য আহরণের অভিযোগে এক অভিযানে ট্রলার ২টিসহ ৭৮ নাবিককে আটক করা হয়েছে। নাবিকসহ ট্রলার দুটি প্যারাদ্বীপের কাছে নেওয়া হয়েছে।

সিঅ্যান্ডএ অ্যাগ্রো লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক সুমন সেন বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে সর্বশেষ তথ্যে আমরা জানতে পেরেছি, ট্রলার দুটি এখন ভারতের উড়িষ্যার প্যারাদ্বীপের কাছে আছে। এর আগ পর্যন্ত ট্রলার দুটি আটক করে নিয়ে যাওয়ার খবর জানলেও অবস্থান কোথায় সেটা জানতাম না। বুধবার (১১ ডিসেম্বর) সকালে ট্রলারের নাবিকদের সঙ্গে স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। তারা এখনো উড়িষ্যার প্যারাদ্বীপে অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত করেছেন।

এফভি মেঘনা-৫ ট্রলারের চীফ ইঞ্জিনিয়ার শরীফুল আলমের বাড়ি ময়মনসিংহ। স্ত্রী ও এক মেয়ে নিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাটে। স্ত্রী মাহমুদা খাতুন স্বামীকে নিয়ে জানালেন উদ্বেগের কথা। মাহমুদা খাতুন বলেন, সোমবার সকালে ঘটনা ঘটেছে। আমি মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে জেনেছি। অফিসে যোগাযোগ করেছি। তারা বলছেন, এগুলো এখন সরকারি সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আর কিছুই আমরা জানতে পারছি না। উড়িষ্যার একটি দ্বীপে নিয়ে নাকি তাদের রাখা হয়েছে। এতদূরে কেন নিয়ে গেল, তাদের (ভারতীয়) উদ্দেশ্য কী- এসব নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে।

মাহমুদা খাতুন আরও বলেন, দেশের সঙ্গে দেশের বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণ নাবিকরা- এদের কী অপরাধ। এদের কেন ধরে নিয়ে যাওয়া হলো, তারা তো দেশের সীমানার মধ্যেই ছিল। সীমানা ক্রস করার কথা বলে শুধু শুধু তাদের আটক করা হল।

তিনি বলেন, শরীফ অনেক বছর ধরে জাহাজে কাজ করছে। আমার বিয়েরও অনেক আগ থেকে করছে। কখনও সে এ ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়েছে বলে শুনিনি। আমরা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছি, দেখি তারা কতটুকু কী করতে পারে। একবার যদি তার (শরীফুল) সঙ্গে কথা বলতে পারতাম, মনকে বোঝাতে পারতাম। আমরা কতটুকু দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি বলে বোঝাতে পারব না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, সবাই যেন ছহি ছালামতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে।

একই ট্রলারের ক্যাপ্টেন (স্কিপার) রাহুল বিশ্বাস। বাড়ি খুলনা জেলার ডুমুরিয়ায়। বাবা-মা সেখানে থাকেন। স্ত্রী ও চার বছরের এক মেয়েকে নিয়ে থাকতেন চট্টগ্রাম নগরীর ফিরিঙ্গিবাজারে। এফভি মেঘনা-৫ সাগরে রওনা দেওয়ার আগে স্ত্রী ও মেয়েকে বাগেরহাটে শ্বশুরবাড়িতে রেখে এসেছিলেন।

এসব তথ্য দিয়ে রাহুলের বাবা অনাদি কুমার বিশ্বাস বলেন, গত মঙ্গলবার সকালে আমি ঘটনা শুনে ওর (রাহুল) অফিসে যোগাযোগ করি। তারা বলছে, কূটনৈতিকভাবে সরকার যা করার করবে, আমাদের দুশ্চিন্তা করতে মানা করল। নিষেধ করলেই কী আর টেনশন কমে? আমাদের এক ছেলে, এক মেয়ে। তার মা তো খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাপের বাড়িতে আমার বৌমাও কান্নাকাটি করছে। নাতনির বয়স মাত্র চার বছর।

১২-১৩ বছর ধরে আমার ছেলে জাহাজে আছে। কোনোদিন এমন ঘটনা ঘটেনি। এখন হঠাৎ কী হল, তাদের একেবারে আটক করে ভারতে নিয়ে যেতে হলো, সেটা বুঝতে পারছি না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, আমার একটাই ছেলে, তাড়াতাড়ি যেন তাকে আমার এবং তার মায়ের বুকে ফিরিয়ে দেয়। প্রার্থনা করছি, সেখানে তাদের ওপর যেন কোনো অত্যাচার-নির্যাতন না করা হয়। বলেন অনাদি কুমার বিশ্বাস।

সিঅ্যান্ডএ অ্যাগ্রো লিমিটেডের তথ্যানুযায়ী, এফভি-মেঘনা ট্রলারটি গত ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে মাছ আহরণের জন্য খুলনায় যায়। সেটি ১৪ ডিসেম্বর ফিরে আসার কথা ছিল। ওই ট্রলারে ৩৭ জন নাবিক ও জেলে এবং ১০০ টন মাছ ছিল। অন্যদিকে এফভি লায়লা-২ ট্রলারে ছিল ৪১ জন নাবিক ও জেলে এবং ৮ টন মাছ। ট্রলারটি চট্টগ্রাম থেকে রওনা করে গত ২৭ নভেম্বর। সেটি ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ফিরে আসার কথা ছিল। এফভি লায়লা-২ এর মালিক প্রতিষ্ঠান ঢাকার। প্রতিষ্ঠানটির কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদফতরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম বলেন, নাবিকসহ ট্রলার দুটি ফিরিয়ে আনতে কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলো ভারতের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগসহ সার্বিক কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

ঈশান/মখ/মসু

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page