বৃহস্পতিবার- ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫

ভুয়া বিলে অর্থ লুটছে চট্টগ্রাম বন্দরের তত্ত্বাবধায়ক শাহজাহান

print news

অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন খরচের ভুয়া বিল বানিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের রিভলভিং ফান্ডের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন নিরাপত্তা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক শাহজাহান ভূঁইয়া। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে বন্দরের টাকা আত্মসাৎ করলেও তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে তার অনিয়ম-দুর্নীতি এখন প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে।

শুধু তাই নয়, সরকারি চাকরির বিধান মতে, একটি বিভাগে দুই বা ততধিক বছর পার হলে কর্তৃপক্ষ অন্য বিভাগে পাঠাতে পারে। কিন্তু নোয়াখালীর সেনবাগের বাসিন্দা এই শাহজাহান অদৃশ্য ক্ষমতাবলে নিরাপত্তা বিভাগে বছরের পর বছর থেকে দুর্নীতির শেকড় মজবুত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

গত বছর বন্দর চেয়ারম্যানের কাছে নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ এনে চিঠি দিয়েছেন কয়েকজন ভুক্তভোগী। চিঠিতে এক ভুক্তভোগী অভিযোগ করে বলেন, নিরাপত্তা বিভাগের বিল শাখায় মাসিক বেতন, ওভারটাইম, শিফটিং বিল ও সরকারি স্ট্যাম্প বাবদ ১৮ টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও প্রত্যেক কর্মচারীর কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ১০০ টাকার ওপরে। ডেসপাচ শাখায় বিভিন্ন আবেদনপত্র, রিপোর্ট জমা বাবদ নেওয়া হচ্ছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। ওই চিঠিতেও তত্ত্বাবধায়ক শাহজাহান, ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মো. রফিকসহ বেশ কিছু কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়।

আরেক ভুক্তভোগী গত বছরের জুন মাসে নিরাপত্তা বিভাগের ডেটাবেজ শাখা, গেট পাস শাখা ও নিরাপত্তা অফিসারদের অবৈধভাবে ঘুষ দাবির বিষয়ে বন্দর চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ দেন আরেক ভুক্তভোগী। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, নিয়ম অনুসারে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীর নামে ডেটাবেজ করতে কোনো ধরনের টাকার প্রয়োজন হয় না কিন্তু ডেটাবেজ শাখার কর্মকর্তারা অবৈধভাবে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করছেন।

অস্থায়ী গেট পাস নিতে নির্ধারিত ফি ১২ টাকা ৫৭ পয়সা হলেও নেওয়া হচ্ছে কয়েকগুণ বাড়তি। পাশাপাশি নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তারা তাদের অনুমোদিত স্বাক্ষরের জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করেন ভুক্তভোগী।

ভুক্তভোগীরা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের সাধারণ শাখার তত্ত্বাবধায়ক শাহজাহান ভূঁইয়া অন্তত ৩০ থেকে ৩২টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে অগ্রিম স্বাক্ষরিত ক্যাশমেমো বা চালান বই নিজের সংগ্রহে রাখেন। পাশাপাশি নিজের হাতেও ভুয়া বিল বানিয়ে বরাদ্দকৃত অর্থের পুরো টাকাটাই খরচের হিসাবে দেখিয়ে বিল প্রস্তুত করেন।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

নগরের আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোড এলাকার মাহিন কম্পিউটার অ্যান্ড স্টেশনারি, আরমান কম্পিউটার, নগরের আন্দরকিল্লা নবাব সিরাজদৌলা রোডের নকশা, নগরের জুবলী রোড এলাকার বিসমিল্লাহ মোবাইল গার্ডেন, জুবিলী ট্রেড সেন্টার, বন্দর পোর্ট কানেক্টিং রোড এলাকায় হাজী মোহাম্মদ তসলিম কন্ট্রাক্টর, দ্য অ্যাড, ডাটা ক্লিফসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অগ্রিম স্বাক্ষরিত ক্যাশমেমো বা চালান ব্যবহার করেন শাহজাহান।

এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার কাজে নিয়োজিত গোয়েন্দা সদস্যরা সরকারি বেতন-ভাতা ভোগ করেন। তবুও বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের রিভলভিং ফান্ড থেকে ৩০ জন গোয়েন্দা সদস্যকে অর্থ দেওয়ার কথা। কিন্তু এই বিল পাচ্ছেন মাত্র ৬ থেকে ৭ জন সদস্য। যারা এই অর্থ পাচ্ছেন, তাদের প্রতিজনকে ১০ হাজার টাকা করে দিলেও শাহজাহান বিলের খাতায় ১২ জন সদস্যের অনুকূলে জনপ্রতি বিল দেখাচ্ছেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।

সূত্র মতে, চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ পরিচালনার জন্য যাবতীয় ক্রয় সংক্রান্ত অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। দু‘মাস অন্তর বন্দরের রিভলভিং ফান্ড থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় পাঁচ লাখ টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অগ্রিম স্বাক্ষরিত ভুয়া বিল এবং নিজের হাতে বানানো হিসাবের খাতায় নয়-ছয় করে বন্দরের ওই টাকা মেরে খাচ্ছেন নিরাপত্তা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক শাহজাহান ভুঁইয়া।

সূত্র জানায়, বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ পরিচালনায় যাবতীয় ক্রয় (ফায়ারের বালি, বেলচা, দড়ি, ড্রাম ক্রয়, নিরাপত্তা বিভাগে গাড়ি ও টহল গাড়ির ট্রেকার বিল, গোয়েন্দা সোর্সসহ অন্যান্য) সংক্রান্ত ব্যয় মেটাতে ২০২২ সালের জুলাই মাস থেকে তিন মাস অন্তর ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে দুমাস অন্তর এ বিল দেওয়া হচ্ছে। বন্দরের রিভলভিং কমিটিতে পাঁচজন সদস্য রয়েছেন। তাদের মাধ্যমে এই অর্থের অনুমোদন দেওয়া হয়।

বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বরাদ্দকৃত অর্থের খরচের হিসাব দেখাতে শাহজাহানের বানানো একটি বিলের কপিতে দেখা গেছে, নিরাপত্তা বিভাগের গোয়েন্দা সোর্স মানি বাবদ ১২টি চালানে তিনি খরচ দেখিয়েছেন ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। ফায়ার শাখার জন্য বালি ক্রয় বাবদ একটি চালানে দেখিয়েছেন ৮ হাজার টাকা। আইএসপিএস সংক্রান্ত ও আইসিডি আইসিটি পানগাঁওতে আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ চারটি চালানে দেখিয়েছেন ৩৬ হাজার ৮০০ টাকা, ফায়ার শাখার জন্য ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট, পাইপ ও দড়ি ক্রয় বাবদ একটি চালানে দেখিয়েছেন ১০ হাজার টাকা, নিরাপত্তা বিভাগের গাড়ির ভিটিএস সার্ভিস ফি বাবদ একটি চালানে দেখিয়েছেন ১৬ হাজার টাকা।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

অপরদিকে ফায়ার শাখার জন্য হ্যান্ডমাইক ক্রয় বাবদ একটি চালানে দেখিয়েছেন ৩ হাজার ৬০০ টাকা, গেটে এইচএইচটি এর পরিবর্তে ব্যবহারের জন্য মোবাইল ক্রয় বাবদ দশটি চালানে দেখিয়েছেন ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬০০ টাকা, নিরাপত্তা বিভাগের জন্য ম্যাক্সেল ব্যাটারি ক্রয় বাবদ একটি চালানে দেখিয়েছেন ২ হাজার ৭২০ টাকা এবং ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ টাকার ৭.৫ শতাংশ মূসক প্রদান বাবদ একটি চালানে খরচ দেখিয়েছেন ১৭ হাজার ২৪৪ টাকা। সব মিলিয়ে ৩২টি চালানে ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৯৬৪ টাকা খরচ দেখিয়েছেন তিনি।

নিয়ম অনুযায়ী, বিভাগীয় প্রধানের অনুকূলে খোলা একটি ব্যাংক হিসাবে দুই মাস পরপর ৫ লাখ টাকা জমা হবে। নিরাপত্তা বিভাগ পরিচালনায় যতটুকু খরচ হবে, ঠিক ততটুকু পরিমাণ অর্থের বিল বানিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হয়।

সূত্রের দাবি, শাহজাহানের এসব অনিয়মের বিষয়ে পূর্বের কমিটির কাছে অভিযোগ যায়। তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে শাহজাহান ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে তার অনিয়মের বিষয়টি ধামাচাপা দেন। পরে কমিটির দুই সদস্যকে কমিটি থেকে বের করে দেওয়া হয়। ওই কমিটির এক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের সাধারণ শাখার তত্ত্বাবধায়ক শাহজাহান ভূঁইয়া বলেন, আপনি আমাদের পরিচালক স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। স্যারই তো সব কাগজপত্রে সই করেন। আমি তার অনুমতি ছাড়া কিছুই করি না। আমার কাছে কোনো ধরনের ক্যাশমেমো বা চালানের কপি নাই। আমার দরকার কী অন্যকিছু করার? আমাকে কর্তৃপক্ষ যেটা বলে, আমি সেটা করি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কে করছে, কেন আসছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমার ইচ্ছামত বিল তো আর আমি বানাতে পারি না। কোনো অনিয়ম হলে পরিচালক স্যারের তো জানার বা দেখার কথা।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গোয়েন্দা সদস্যের সবাইকে তো আর টাকা দেওয়া সম্ভব হয় না। আর ওখানে ৩০ জন সদস্য আছেন। ওদের তিনজন লিডার থাকেন। তাদেরকে টাকাটা দিয়ে দিই। ওরা কীভাবে টাকা পাবেন না পাবেন, সেটা তো আমার দেখার বিষয় না। আর আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে এগুলো সব মিথ্যা, বানোয়াট।

চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল মোস্তফা আরিফ উর রহমান খান বলেন, রিভলভিং ফান্ডটা জরুরি ভিত্তিতে খরচ করার জন্য দেওয়া হয়। যেমন- একটা দুর্ঘটনা ঘটলে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, তাৎক্ষণিক সেবার ব্যবস্থা করা অর্থাৎ প্রাইভেট বা পাবলিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, নিরাপত্তা বিভাগের টর্চ, মোবাইল, বালু, দড়ি অর্থাৎ জরুরি ভিত্তিতে দরকারি খরচ মেটাতে এই ফান্ড থেকে অর্থটা ব্যয় হয়। নিরাপত্তা বিভাগের কোনো না কোনো সদস্য এটা হ্যান্ডেল (পরিচালনা) করে। আমি তো আর এটা হ্যান্ডেল করি না। আমি শুধু অনুমোদন দিই। আমার জানা মতে, আমার বিভাগের যে সদস্য বিষয়টা দেখে, অনিয়ম হওয়ার কথা না। কারণ খরচের রেজিস্ট্রারটা আমি দেখি।

তিনি আরও বলেন, তিনটা গ্রুপে ৩০ জন গোয়েন্দা সদস্যকে সোর্স মানিবাবদ প্রতিজনকে মাসে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। এখন ওই টাকা সবাই হয়তো পাচ্ছেন না। আমি খুব সচেতনভাবে বিষয়টা দেখি। তবে এখন থেকে আরও বেশি সচেতন হব। যেহেতু ভুয়া বিল বানানোর প্রসঙ্গ এসেছে, তাই আমি বিভাগের ওই সদস্যের কাছ থেকে সব হিসাব আমার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসব। আমি নিজেই এখন থেকে সব খরচ দেখভাল করব। আর গোয়েন্দা সদস্যদের ফি এখন থেকে প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলের মোবাইলফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি।

ঈশান/খম/সুপ

আরও পড়ুন

No more posts to show