
শুধু অবৈধ দোকানের জমিদার নন, মাদক বানিজ্যেরও গডফাদার চট্টগ্রামের আলোচিত ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার মুহাম্মদ জয়নাল। দীর্ঘ এক বছর ধরে এই জংশনে ইয়াবা, গাজা, আইসসহ বিভিন্ন মাদকের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
এই ব্যবসা চালাতে স্তরে স্তরে তিনি সাজিয়ে তুলেছেন একাধিক অপরাধ চক্রও। এরমধ্যে রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন ও রাজনৈতিক পরিচয়ে দুস্কৃতিকারীরা অন্যতম। যারা মূলত এসব মাদকদ্রব্য বিক্রী করে। আর এই ব্যবসার মুল গডফাদার হচ্ছেন স্টেশন মাস্টার জয়নাল।
যদিও মাদক বানিজ্যের কথা স্বীকার করেননি স্টেশন মাস্টার জয়নাল। তবে বিষয়টি স্বীকার করেছেন ষোলশহর রেল স্টেশনের পেছনে রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে গড়ে তোলা মাদকের কলোনি সিন্ডিকেটের একজন মোহাম্মদ রফিক।
গত মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) সরেজমিন পরিদর্শনের সময় প্রশ্নের উত্তওে মো. রফিক বলেন, ষোলশহর স্টেশনে মাদকের যে বিশাল বানিজ্য, তা পুলিশও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা।
তিনি বলেন, নেশাখোর ও নেশাদ্রব্য বিক্রেতা যতদিন থাকবে, ততদনি এটা বন্ধ করার সাধ্য কারও নাই। সরকার যতই আইন করুক কোন লাভ হবে না। তার মাদকের কলোনি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন করি। নিতাই বাবু, মনজুসহ কয়েকজনে মিলে আমরা কলোনি করেছি। এখানে ২৫টির মতো বাসা আছে। সেখান থেকে ভাড়া উঠে ২০-২২ হাজার টাকা। সেগুলো দিয়ে তো সংগঠন চলে না। এরপর আর কিছুই বলতে নারাজ তিনি।
ভাড়া ঘরের কলোনি গড়ে তোলার বৈধতা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শ্রমিক ইউনিয়ন করলে কিছুই লাগেনা। স্টেশন মাস্টারের অনুমতি নিয়ে কলোনি করেছি। প্রতিমাসে উনাকে ভাড়া দিই।
জায়গার ভাড়াসহ স্টেশন মাস্টার জয়নালকে মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন শ্রমিক ইউনিয়নের গড়ে তোলা কলোনির কেয়ারটেকার মো. রশিদ।
তিনি বলেন, ২৫টি ঘরের কোন কোনটি থেকে ৫ হাজার, আবার কোনটি থেকে ৪ হাজার-সাড়ে ৪ হাজার টাকা মাসিক ভাড়া পাই। প্রতিমাসে এক লাখ টাকার মতো আসে। কিন্তু স্টেশন মাস্টার জয়নালকে প্রতিমাসে দিতে হয় এক লাখ টাকা। যার কারণে অন্য ব্যবসা করতে হয়। অন্য ব্যবসা কি জানতে চাইলে, তিনি শুধু হাসেন।
তিনি বলেন, ঘর ভাড়া কলোনি ও মাদকের ব্যবসা এখানে আরও অনেকে করেন। এখানে এ রকম আরও অন্তত ৪০-৫০টি কলোনি আছে। সবগুলোতে ইয়াবা, গাজাসহ নানা ধরণের মাদক বেচাকেনা হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ষোলশহর স্টেশনে হাজারেরও বেশি নেশাখোরের আড্ডা জমে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পুলিশ এখানে আসলেও এখন আসে না। পুলিশ তখন আসলে মাদক বিক্রেতাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলে যেত।
গত ২১ জানুয়ারি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কথা হয় মণির হোসেন (৪২) নামে নেশাগ্রস্ত একজনের সাথে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, গাজা, ইয়াবা খাই। রাতে স্টেশনে ঘুমাই। এ রকম ১০০ জনেরও বেশি আছে। তবে নেশা খায় এমন লোক হাজারেরও বেশি। আগে পুলিশ তাড়ায়তো, এখন পুলিশ আসে না।
স্টেশনের এক দোকানদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ষোলশহর স্টেশন একটা জাহান্নাম। এখানে ৭০০রও বেশি অবৈধ দোকান রয়েছে। যেখান থেকে প্রতিমাসে অর্ধকোটি টাকা ভাড়া পান স্টেশন মাস্টার জয়নাল। ভাসমান ভ্যান গাড়ি থেকেও প্রতিদিন ভাড়া পান লাখ টাকার বেশি। এরপরও তিনি স্টেশন ঘিরে চালাচ্ছেন মাদক বানিজ্য। এ নিয়ে মুখ খোলার সাহস কারো নেই। মুখ খোললে তার নিয়ন্ত্রণে থাকা অপরাধ চক্রের চিহ্নিত সদস্যরা হামলা চালায়।
আবার এসব অপকর্ম ঢাকতে তিনি সাংবাদিকও পোষেন। অনেক সাংবাদিক ১৫-২০ দিন বা এক মাস পরপর এসে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যান। যার কারণে এসব নিয়ে সাংবাদিকদের বললেও কোন কাজ হয়না। এ কারণে সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের প্রতিও আস্থা হারিয়েছেন।
যার প্রমাণ পাওয়া গেল ষোলশহর স্টেশন মাস্টার মুহাম্মদ জয়নালের সাথে কথা বলে। সম্প্রতি মুঠোফোনে এসব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জয়নাল বলেন, ফোনে নয়, আপনি অফিসে আসেন কথা বলব। অফিসে গেলে তিনি মাহবুব নামে এক সাংবাদিকের রেফারেন্স তুলে ধরে বলেন, উনাকে চিনেন। উনার সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। আপনার সাথেও থাকবে-এ কথা বলে তিনি মাহবুবের সাথে কথা বলার অনুরোধ করেন। কথা না বলায় স্টেশনে অবৈধ দোকান থেকে ভাড়া আদায় ও মাদক বানিজ্যের বিষয়ে তার কিছুই বলার নেই বলে জানান তিনি।
রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, স্টেশন মাস্টার জয়নাল খুবই বেপরোয়া। তার বাড়ি চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানা এলাকায়। যা স্টেশন থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দুরে। অথচ রেলের চাকরির বিধিতে রয়েছে কোন স্টেশন মাস্টার নিজ জেলায় চাকরি করতে পারবে না। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তিনি জেলা তো দুরের কথা, একেবারে ঘরের কাছেই চাকরি করছেন।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, অবৈধ দোকান ভাড়া ও মাদক বানিজ্যসহ নানা অপরাধ, অনিয়ম, দূর্নীতিতে ডুবে থাকলেও রেলের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্টেশন মাস্টার জয়নালের বিষয়ে নিরব। কারণ তার অবৈধ আয়ের টাকার ভাগ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের শীর্ষ কর্মকর্তা পর্যন্ত পৌছে।
তাছাড়া তিনি এক সময় ছাত্রলীগের ক্যাডার ছিলেন। জুলাই বিপ্লবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি বিপুল অর্থ দিয়েছেন যুবলীগ-ছাত্রলীগকে। যা দিয়ে অস্ত্র কিনে চট্টগ্রামেও হত্যাকান্ড চালিয়েছে যুবলীগ-ছাত্রলীগ।
এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিটিও আনিসুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। গত ২১ জানুয়ারি মঙ্গলবার দুপুরে অফিসে গেলে দেখা যায় দরজার বাইরে সিটকারি লাগানো। এ সময় অফিসের পিয়ন স্বপন বলেন, স্যার ঢাকায় আছেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার মাহবুবুল আলম বলেন, ষোলশহর স্টেশনের বিষয়ে অভিযোগ শুনেছি। কিন্তু লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিতে সুবিধে হত। আর স্টেশনগুলোর অভিযোগ ভিন্ন ভিন্ন। তম্মধ্যে টিকেট বানিজ্যের বিষয়টি কমার্শিয়ালের। বিষয়টি আমি দেখব। খোঁজ নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে বুধবার (২২ জানুয়ারি) দুপুরে অফিসে গিয়ে দেখা যায় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. সুবক্তগীন রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ব্যস্ত। দলে দলে নেতা আসা-যাওয়ার কারণে পরে কথা বলবেন বলে জানান তিনি।
( বি: দ্র:- শীগগীর আসছে ষোলশহর স্টেশন মাস্টার জয়নালের লুটপাটের তৃতীয় প্রতিবেদন। প্রিয় পাঠক চোখ রাখুন দৈনিক ঈশানে)
ঈশান/খম/সুম
পড়ুন প্রথম প্রতিবেদন : রেলওয়ের চট্টগ্রাম ষোলশহর স্টেশনের জমিদার স্টেশন মাস্টার জয়নাল!