জো বাইডেন সরে দাঁড়ানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে নতুন প্রার্থী হওয়া কমলা হ্যারিসকে ঘিরে নির্বাচনী সমাবেশ শুরু করতে এক ঘণ্টারও কম সময় লেগেছিল ডেমোক্র্যাটদের। দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তার প্রচার উদারপন্থি ভোটারদের পুনরুজ্জীবিতও করেছে।
সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমলা হ্যারিসের প্রচার তহবিলে জমা পড়েছে ৬৭.১ কোটি ডলার অনুদানও, যা তার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংগ্রহের প্রায় তিনগুণ। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর এই দৌড়ে কমলা হ্যারিসের রয়েছে ঘটনাবহুল ও বর্ণিল একটি সফর।
কমলার বেড়ে ওঠা, তার কর্মজীবন, রাজনীতিতে প্রবেশ, উল্লেখযোগ্য ঘটনাপ্রবাহ এবং কীভাবে তিনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হলেন সেই বিষয়ে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে।
কমলা হ্যারিস ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে অভিবাসী যুগলের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার মা ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং বাবা জ্যামাইকান আমেরিকান। কমলার বয়স যখন পাঁচ, তখন তার বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। তারপর মূলত মা শ্যামলা গোপালন হ্যারিসের কাছেই বড় হন তিনি।
কমলা হ্যারিস জানান, তাকে এবং তার ছোট বোন মায়াকে ওকল্যান্ডের কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মাঝেই বড় করে তুলেছিলেন তার মা, যিনি একজন ক্যান্সার গবেষক এবং নাগরিক অধিকারকর্মী ছিলেন। তার আত্মজীবনী ‘দ্য ট্রুথস উই হোল্ড’-এ তিনি লেখেন, ‘আমার মা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি দুজন কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েকে লালন পালন করছেন।
তিনি জানতেন যে তার নতুন দেশ মায়া এবং আমাকে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে হিসাবে দেখবে এবং আমরা যাতে আত্মবিশ্বাসী, গর্বিত কৃষ্ণাঙ্গ নারী হয়ে উঠি তা নিশ্চিত করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।’
প্রসঙ্গত, শ্যামলা গোপালন হ্যারিস ভারতীয় ছিলেন। তার আদি বাড়ি ভারতের তামিলনাড়ুতে। ১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। কমলা হ্যারিস হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ এবং যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত সম্পর্কের মতো রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে তিনি সোচ্চার হতে থাকেন। তার কর্মজীবনও বেশ সফল।
কমলা হ্যারিসের স্বামী আইনজীবী ডাগ এমহফ। তার সঙ্গে একটা ব্লাইন্ড ডেটে আলাপ হয়েছিল কমলার। ২০১৪ সালে এই যুগল বিয়ে করেন। ডাগ এমহফের সন্তান কোল এবং এলা কমলা হ্যারিসকে মোমালা বলে ডাকে।
পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কমলা হ্যারিস এলি ম্যাগাজিনকে বলেছিলেন, ‘রোববার নৈশভোজ আমাদের কাছে পারিবারিক সময়। কোল টেবিল সেট করে এবং সংগীত বাছাই করে। এলা ডেসার্ট (মিষ্টান্ন) তৈরি করে, ডাগ আমার স্যুস-শেফ হিসাবে কাজ করে এবং আমি রান্না করি।’
আইনজীবী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন কমলা হ্যারিস। আলামেডা কাউন্টির ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নির দপ্তরে কর্মরত ছিলেন তিনি। এরপর সান ফ্রান্সিসকোর ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি হিসাবে কাজ করেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হিবেবে, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যে শীর্ষ আইনজীবীর দায়িত্বও পালন করেন তিনি। কমলাই প্রথম নারী এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব যিনি এই পদে দায়িত্ব সামলেছেন।
তার এই সাফল্য ২০১৬ সালের ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর নির্বাচনের প্রচারে গতি আনে এবং তার বিজয় নিশ্চিত করে। এরপর ২০২০ সালে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে মনোনীত হওয়ার জন্য প্রচার চালান। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়েই সেই দৌড় থেকে বেরিয়ে যান তিনি।
শুরুর দিকে তার প্রচার সভাগুলোয় বিপুল জনসমাগম ও বিতর্ক অনুষ্ঠান সরগরম হওয়া সত্ত্বেও কমলা হ্যারিস তার মতাদর্শ ও নীতিনির্ধারণী প্ল্যাটফর্ম স্পষ্ট করতে পারেননি। অল্প সময়ের মধ্যেই তার সেই প্রচার গতি হারিয়ে ফেলে। তাকে স্পটলাইটে ফিরিয়ে আনেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসাবে মনোনীত হওয়ার পরই জো বাইডেন তার রানিং মেট হিসেবে কমলা হ্যারিসকে বেছে নিয়েছিলেন। তার সম্পর্কে বাইডেন বলেছিলেন, কমলা স্মার্ট, শক্ত, অভিজ্ঞ এবং একজন প্রমাণিত যোদ্ধা।
একসঙ্গে তারা ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার রানিং মেট মাইক পেন্সকে পরাজিত করেন। কমলা হ্যারিসকে বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারের সময় পেছনের আসনে দেখা গেলেও এই সাফল্যে একজন নারী এবং কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। এর কারণ হলো কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের ভোটের ৯০% তাদের ঝুলিতে ছিল।
২০২০ সালের কমলা হ্যারিস প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম এশিয়ান মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাস তৈরি করেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছিলেন, ‘কক্ষে কমলার কথাই শেষ কথা হবে। তিনি প্রচলিত অনুমানকে চ্যালেঞ্জ করবেন এবং কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসাও করবেন।’
২০২১ সালের নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চিকিৎসাগত কারণে মেডিকেল পরীক্ষা করাতে হয়েছিল। সেই সময় ৭৫ মিনিটের জন্য ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় ছিলেন কমলা হ্যারিস।
মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে, কমলা হ্যারিস মার্কিন সিনেটেরও প্রেসিডেন্ট। বিল পাসের ক্ষেত্রে ভোট টাই হয়ে গেলে তিনি ভোট দিতে পারেন। তার সেই ক্ষমতা ৩২ বার ব্যবহার করে নজির গড়েছেন তিনি। মার্কিন ইতিহাসে অন্য কোনো ভাইস প্রেসিডেন্ট এতবার ওই ক্ষমতা ব্যবহার করেননি।
তার বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইন, আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যান পাসে সহায়তা করেছিলেন যা কোভিডের সময় আর্থিক সহায়তা এবং অন্যান্য ত্রাণ সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হোয়াইট হাউসে থাকাকালীন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসীর ঢলের আবহে অভিবাসন সংকট মোকাবিলা করার দায়িত্ব কমলাকে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এটা এমন একটা ইস্যু যাকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা তাকে প্রায়শই কটাক্ষ করে থাকে। তার কারণ এই উদ্যোগে তেমন একটা অগ্রগতি দেখা যায়নি এবং ক্ষমতায় আসার পর সীমান্তে যাওয়ার পরিকল্পনা করতেই ছয় মাস সময় লেগে গিয়েছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের। একে কেন্দ্র করে রিপাবলিকান তো বটেই ডেমোক্র্যাটদের অনেকেও তার সমালোচনা করতে ছাড়েননি।
গর্ভপাতের অধিকারের গ্যারান্টি দেওয়া অর্ধশতাব্দী ধরে চলে আসা অধিকারের উপর ২০২২ সালে নিষেধাজ্ঞার ফলে যে নেতিবাচক প্রভাব দেখা গিয়েছে সে বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে তুলে ধরার দায়িত্ব পালন করছেন কমলা।
আগস্টে ডেমোক্র্যাটিক কনভেনশনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল প্রজননের অধিকার সংক্রান্ত ইস্যু। এই প্রসঙ্গে কনভেশনে যে বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল তা হলো স্বাধীনতা। সেখানে তার ভাষণে দেশজুড়ে গর্ভপাতের সুযোগ সীমিত করার প্রচেষ্টার স্থপতি হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের কড়া ভাষায় সমালোচনা করেন কমলা হ্যারিস।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় তার নির্বাচনী প্রচার অনেকটাই পরে শুরু করেছেন কমলা। তবে প্রচারে নেমে প্রথম সমাবেশেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ‘আক্রমণাত্মক’ ভূমিকায় দেখা যায় তাকে। নভেম্বরের নির্বাচনকে তিনি ‘প্রাক্তন প্রসিকিউটর এবং দোষী সাব্যস্ত অপরাধীর মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়ার’ লড়াই হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
জুলাই মাসে তার প্রচারাভিযান শুরুর সময় উইসকনসিনে প্রায় তিন হাজার লোকের জমায়েতে নিজের বক্তব্য রাখতে গিয়ে কমলা হ্যারিস হোয়াইট হাউসের দৌড়ে শামিল তার রিপাবলিকান প্রতিপক্ষের সঙ্গে তুলনা করেছেন প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে একসময় মামলা লড়েছিলেন তিনি।
অন্যদিকে, ভোটারদের কাছে নিজেকে নতুনভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছে কমলাকে। ২০২০ সালে নির্বাচনি প্রচারের সময় তিনি অভিবাসন, এলজিবিটি অধিকার এবং অন্যান্য ইস্যুতে বামপন্থি ঝোঁকের কথা বলেছিলেন তবে প্রসিকিউটর হিসাবে তার ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে তাকে আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল।
চার বছর পর চলতি বছরের নির্বাচনী দৌড়ে কমলা নিজেকে একজন আইনের শাসক হিসাবে তুলে ধরতে চাইছেন যিনি দোষী সাব্যস্ত হওয়া ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেবেন। তবে একইসঙ্গে প্রগতিশীল নীতি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন যা তার পরিবারের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারকে তুলে ধরবে। কমলা বলেন, ‘আমার পুরো ক্যারিয়ারে, আমি কেবল একজন ক্লায়েন্টকেই পেয়েছি, সেটা হলো জনগণ।’
আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়েও কমলা তার অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসির অংশীদার সিবিএস নিউজের এক সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয় ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের ‘শক্তিশালী মিত্র’ কি না।
উত্তরে কমলা বলেন, ‘ইসরায়েলের নেতৃত্বের সঙ্গে আমরা কূটনৈতিকভাবে যে কাজ করছি তা আমাদের নীতি স্পষ্ট করার জন্য একটা চলমান প্রচেষ্টা।’ অন্যদিকে, ইউক্রেন-রাশিয়া ইস্যু নিয়ে তিনি জানিয়েছেন ইউক্রেন আলোচনার টেবিলে না বসলে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বসবেন না।