
চট্টগ্রামের শস্যভান্ডার রাঙ্গুনিয়া গুমাইবিলে কৃষি জমিতে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ইটভাটা। রাজানগর, ইসলামপুর, লালানগর, নিচিন্তাপুর, চন্দ্রঘোনা, পোমরা ও সরফভাটা ইউনিয়নের ফসলি জমি ও সংরক্ষিত বনের ভেতরেও গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা। এমনকি কোদালা চা-বাগানের পাশে কর্ণফুলী নদীর তীর কেটেও গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা।
শুধু রাঙ্গুনিয়ায় নয়, চট্টগ্রামের রাউজান, হাটহাজারী, সীতাকুন্ড, মিরসরাই, আনোয়ারা, পটিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও বোয়ালখালী উপজেলার জনবসতিপূর্ণ এলাকায় কৃষি জমিতেও গড়ে উঠেছে ইটভাটা। ফসলি জমি বা পাহাড়ি ভুমি নষ্ট করে তৈরি হওয়া এসব ইটভাটাগুলোর আশেপাশে রয়েছে জনবসতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব ইটভাটাগুলো ফসলি জমি থেকে মাটি নিচ্ছে এবং ইট পোড়ানোর সময় নির্গত কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষিত হওয়ার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। প্রশাসনের নীরবতায় অনুমোদনহীন ইটভাটাগুলোর কার্যক্রম বন্ধের কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি আনোয়ারা উপজেলার পরীরবিল এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বটতলী ইউনিয়নের পশ্চিমে পরীরবিল এলাকায় তিন ফসলি জমিতে পরিচালনা করা হচ্ছে মোহছেন আউলিয়া ব্রিকস (এমবিএম) নামক একটি ইটভাটা।
স্থানীয়দের ভাষ্য, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র কিংবা জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে এই অবৈধ ইটভাটা। বছরের পর বছর এই অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম চললেও প্রশাসন নির্বিকার। স্থানীয়দের অভিযোগ, ইটভাটার মালিক সামসুল আলম প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চালাচ্ছেন এই ইটভাটা।
২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর এই ইটভাটা উচ্ছেদের জন্য তিন মাসের সময় দিলেও বাস্তবে এর কোন প্রতিফলন ঘটেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহছেন আউলিয়া ব্রিকস (এমবিএম) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামশুল আলম জানান, অনুমোদন না থাকলেও তিনি প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে “ম্যানেজ” করেই ব্যবসা চালাচ্ছেন। ২০২১ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ইটভাটা বন্ধের নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি সবাইকে “ম্যানেজ” করে মাটি কাটা ও উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন।
এর প্রতিফলন ঘটে গত বুধবার (৮ জানুয়ারি) পরিচালিত অভিযানে। অভিযান পরিচালনা করে এই ইটভাটার মালিককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে প্রশাসন। এর মধ্যে আশ্চর্যজনক বিষয়, ইটভাটাটিকে লাইসেন্স ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরির জন্য আরও দুই মাসের সময় দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের এই পদক্ষেপ তাদের দায়সারা মনোভাবকেই ফুটিয়ে তুলেছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ারা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হুসাইন মুহাম্মদ জানান, আইনানুগ অভিযানে জরিমানা করা হয়েছে এবং পরবর্তী দুমাসের মধ্যে লাইসেন্স না করলে আবার অভিযান করা হবে। এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, প্রশাসন কার্যত ইটভাটাটিকে তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
এ বিষয়ে মোহছেন আউলিয়া ব্রিকস (এমবিএম) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামশুল আলম জানান, অনুমোদন না থাকলেও তিনি প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে “ম্যানেজ” করেই ব্যবসা চালাচ্ছেন। ২০২১ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ইটভাটা বন্ধের নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি সবাইকে “ম্যানেজ” করে মাটি কাটা ও উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন।
একইভাবে সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার উত্তরাংশে স্বনির্ভর ইউনিয়নের ইসলামাবাদ ও মজুমদারখীল গ্রামের পাশের জমি থেকে স্কেভেটর দ্বারা শুরু হয়েছে মাটিকাটা। আইন অমান্যকারীরা কর্তিত মাটি বিক্রি করে অবৈধ অর্থ রোজগারের উপায় অবলম্বন করলেও ফসলি জমির উর্বরাংশের মাটি কর্তনে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শস্যভান্ডারখ্যাত গুমাইবিলের ফসলি জমিও ধ্বংস হচ্ছে ইটভাটায়। এ বিলের উত্তর-পূর্বাংশে হোসনাবাদ ইউনিয়নের নিশ্চিন্তাপুর, কানুরখীল, আন্ন সিকদারপাড়া, দক্ষিণে মরিয়মনগর ও চন্দ্রঘোনা-কদমতলী ইউনিয়ন, কাপ্তাই রোড ও পশ্চিমে ডিসি রোড সংলগ্ন ফসিল জমি ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে আবাসন ও বাণিজ্যিক দালান।
এ ব্যাপারে প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা রাঙ্গুনিয়া উপজেলা মডেল শাখা, পৌরসভা শাখা ও রাঙ্গুনিয়া প্রেস ক্লাব কর্তৃপক্ষ উদ্বেগ প্রকাশের পর গত ৭ জানুয়ারি বুধবার রাঙ্গুনিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তখন কৃষি জমির টপ সয়েল কাটার অপরাধে অপরাধী ইসমাঈল সিকদারকে বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ মূলে ৫০ হাজার টাকা অর্থ দণ্ড প্রদান করা হয়।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতেও কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেওয়ায় শামসুল হুদা চৌধুরী নামের এক ব্যক্তিকে অর্থদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বুধবার (৮ জানুয়ারি) বিকেল ৩টার দিকে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পশ্চিম সারোয়াতলীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হিমাদ্রী খীসা।
তিনি জানান, কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেওয়ার দায়ে শামসুল হুদা চৌধুরী নামের এক ব্যক্তিকে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কৃষিজমি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
আইন অনুযায়ী, কৃষিজমিতে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে, বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটার এবং ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়কের অন্তত আধা কিলোমিটারের মধ্যে কোন ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। এই আইন অমান্য করলে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড, অন্যূন ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
কিন্তু চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, হাটহাজারী, সীতাকুন্ড, মিরসরাই, আনোয়ারা, পটিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও বোয়ালখালী উপজেলায় এই আইনকে উপেক্ষা করেই চলছে ইটভাটা ও আবাসনের রমরমা ব্যবসা। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইটভাটা ও আবাসন মালিকরা কোন প্রকার শাস্তির সম্মুখীন হন না। যদি কখনও শাস্তি হয়ও, তারা কৌশলে একই স্থানে পুনরায় ইটভাটার কার্যক্রম শুরু করেন।
অবৈধ ইটভাটার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন ফয়সাল জানান, চট্টগ্রামের সবকটি উপজেলায় ৩০০টির মতো ইটভাটা রয়েছে। যার অধিকাংশই কোন না কোন কারণে অবৈধ। ইটভাটাগুলো পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. মোজাহিদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী এই অভিযানকে “লোক দেখানো” বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, অবৈধ ইটভাটা মালিকদের সাথে সংশ্লিষ্টদের একটা অবৈধ যোগসূত্রে এসব চলে। সত্যিকারের পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে এসব ইটভাটা গুঁড়িয়ে দিতে হবে কোনো কথা ছাড়া। সময় কেন? এই অভিযানগুলো জাস্ট জনসাধারণকে আশ্বস্ত করা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, এই ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জরিমানা করে অবৈধ ইটভাটাকে সময় দেওয়ার মাধ্যমে প্রশাসন কার্যত তাদের অবৈধ কার্যক্রমকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে প্রশাসনের এই ঢিলেঢালা মনোভাব হতাশাজনক।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে এই বিষয়ে অবগত করা হলে তিনি জানান যে, তিনি বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেবেন।