বৃহস্পতিবার- ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫

রঞ্জু গেলেও সিটিভি লুটে খাচ্ছে রোমানা শারমিন!

রঞ্জু গেলেও বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র লুটে খাচ্ছেন রোমানা!
print news

ওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে সারাদেশের মতো দূর্নীতির কুরুক্ষেত্র ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রও। যদিও এ বিষয়ে কেউ কোন সময় মুখ খোলার সাহস করেনি। কোন সাংবাদিক এ বিষয়ে ঘাটাঘাটিও করলেও তাকে হয় স্থায়ী-অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরি, নয় মোটা অংকের অর্থ দিয়ে মুখে কুলুপ বা হাত ভারী করে দিয়েছে। এই সুবিধায় চট্টগ্রামসহ সারাদেশের  অনেক সাংবাদিক বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে স্থায়ী-অস্থায়ী ভিত্তিতে এখনো চাকরি করছেন। 

আর দূর্নীতির এই মূল হোতা ছিল স্বয়ং বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) নুর আনোয়ার হোসেন রঞ্জু ও প্রযোজক কন্ট্রোলার বা প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমিন। তবে শেকড় আরও গভিরে। অর্থাৎ দূর্নীতির মূল হোতা নুর আনোয়ার হোসেন রঞ্জু ও রোমানা শারমিনের নিয়োগদাতা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ঈমাম, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। যারা এই দুই কর্মকর্তা থেকে উপরে-নিচে নিয়েছেন নানা অনৈতিক সুবিধাও।

যা ‍দিতে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের উপকরণ ক্রয়, ভুয়া অনুষ্ঠান ও শিল্পী সম্মানীর নামে ভুয়া বিলসহ নানা উপায়ে করেছেন কোটি কোটি টাকা লোপাট। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এ বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনেকেই। যদিও চাকরি হারাবার ভয়ে কেউ নাম প্রকাশ করার সাহস করছেন না এখনো। যাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দৈনিক ঈশানসহ দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের দূর্নীতির একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর শাস্তিমূলক বদলি করা হয় জেনারেল ম্যানেজার নুর আনোয়ার হোসেন রঞ্জুকে। বর্তমানে এ পদে তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন মো. ইমাম হোসাইন। গত ১২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার পদের দায়িত্বে যুক্ত হয়েছেন তিনি।

তবে এখনো রয়ে গেছেন রঞ্জুর প্রেতাত্না প্রযোজক কন্ট্রোলার বা প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমিন। যিনি এখনো ভুয়া অনুষ্ঠান ও শিল্পী সম্মানীর নামে ভুয়া বিলসহ নানা উপায়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন এসব তথ্য।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৫ সেপ্টেম্বর বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে ‘রান্না কথন’ নামে ২৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থাপক ও আলোচক ছিলেন একজন করে। অথচ ওই অনুষ্ঠানের বিল করা হয়েছে ১২ জনের নামে। যার মধ্যে আলোচক দেখানো হয়েছে আটজন। যা অবাস্তব বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

বিল পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা ২ হাজার টাকা, আলোচক ৩ হাজার ও অনুষ্ঠান সহকারী দু’জন ৪ হাজার ৩৩২ টাকা সম্মানী পেয়েছেন। সব মিলিয়ে এই অনুষ্ঠানে সর্বমোট ১৭ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হলেও বিল করা হয়েছে ৩৫ হাজার ৫৩২ টাকা।

একইভাবে গত ২ আগস্ট মহেশখালীর ধলঘাটা দ্বীপ নিয়ে ‘দ্বীপ দর্পণ’ অনুষ্ঠানের প্রচার হয়। যার বাজেট দেখানো হয়েছে ৯৯ হাজার ৪১০ টাকা। এই অনুষ্ঠানে উপস্থাপক, নেপথ্যে ধারা বর্ণনাকারী ছাড়াও সাক্ষাৎকার প্রদানকারী হিসেবে ১৮ জনের নামে প্রায় ৭০ হাজার টাকা বিল করা হয়েছে। বাজেটে ‘দ্বীপ দর্পণ’ অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি ২৫ মিনিট উল্লেখ থাকলেও প্রচারিত অনুষ্ঠানের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ৫.১৭ মিনিট। ৫ মিনিটের অনুষ্ঠানে ১৮ জনের সাক্ষাৎকার প্রচারও অবাস্তব বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

di546 2

গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিয়মিত অনুষ্ঠান ধারণ ও প্রচার প্রায় বন্ধ থাকলেও ২ কোটি ২০ লাখ টাকা বাজেট করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেড় কোটি টাকা উত্তোলনও করা হয়েছে। এভাবে বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক জিএম আনোয়ার হোসেন রঞ্জু ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমিন সিন্ডিকেট গত দেড় বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকা লুটপাট করেছে। যা অনুষ্ঠানমালার বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ।

২০২৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে নির্মিত অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে অভিনেতা জায়েদ খানসহ বিভিন্ন শিল্পীকে আনা হয়। এক দিনের অনুষ্ঠানে বাজেট দেখানো হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। এ থেকে অন্তত ১৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের জনপ্রিয় শিল্পী কল্যাণী ঘোষ বলেন, ‘চট্টগ্রাম টেলিভিশন কেন্দ্রের বর্ষপূর্তিতে ঢাকা থেকে শিল্পী এনে অনুষ্ঠান করা হয়েছে, অথচ চট্টগ্রামের কোনো গুণী শিল্পীকে দাওয়াতই দেওয়া হয়নি। চট্টগ্রামের শিল্পীদের বঞ্চিত করা হয়েছে।’

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

একই সালের ডিসেম্বরে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ৩১ পর্বের ‘বিজয় গাথা অনুষ্ঠান’ নির্মাণে বাজেট ছিল ১২ লাখ টাকা। অথচ ২০২২ সালে ৩১ পর্বে খরচ হয়েছিল মাত্র ৪ লাখ টাকা। ২০২৩ সালে ‘বদলে গেছে বাংলাদেশ’ শিরোনামে সরকারের উন্নয়ন প্রচারধর্মী ৯৮ পর্বের অনুষ্ঠানে খরচ দেখানো হয় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, ইন্টারনেট থেকে নেওয়া ফুটেজ দিয়ে এসব অনুষ্ঠানের বেশির ভাগ টাকাই আত্মসাৎ করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ২০২২-২৩ অর্থবছরে অনুষ্ঠান শাখার বাজেট ছিল ৮ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিএম নুর আনোয়ার হোসেন রঞ্জুর সময় বাজেট বেড়ে হয়েছে ১৩ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজেট ৫ কোটি টাকা বাড়লেও অনুষ্ঠানের সংখ্যা ও মান ছিল নিম্নমুখী। অর্থ লুটপাটের জন্য প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানের বাজেট বাড়ানো হয়েছে কয়েক গুণ। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ৩৪৩টি বিশেষ অনুষ্ঠান নির্মাণে খরচ হয় ৪৭ লাখ ১৩ হাজার টাকা। ২০২৩ সালে শুধু ১০৬টি বিশেষ অনুষ্ঠান নির্মাণে মোট বাজেট ছিল ৬১ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এক বছরের ব্যবধানে গড়ে প্রতিটি অনুষ্ঠানের বাজেট চার গুণ বেড়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রে বহির্দৃশ্য ধারণের জন্য দুটি ক্যামেরা রয়েছে। রয়েছে প্রয়োজনীয় জনবলও। কিন্তু ওই ক্যামেরাগুলো অকেজো দেখিয়ে বাইরে থেকে বেশি টাকায় ক্যামেরা, ড্রোনসহ নানা উপকরণ ভাড়া নেওয়ার দাবি করা হতো। এই ব্যয়কে শিল্পী সম্মানী হিসেবে দেখানো হতো। এভাবে দু’জনের অনুষ্ঠানে আটজন, চারজনের অনুষ্ঠানে ১৫-২০ জন আলোচক ও সাক্ষাৎ প্রদানকারীর নামে বিল করা হতো।

আলোচক ও সাক্ষাৎকার প্রদানকারীরা মূলত সিন্ডিকেটের লোক ছিলেন। এসব বহিরাগত শিল্পী সম্মানীর চেক নিয়ে টাকা উত্তোলন করে এর বড় অংশ প্রযোজক বা সংশ্লিষ্টদের কাছে ফেরত দিতেন বলে জানা গেছে। এভাবে একেকটি অনুষ্ঠানে প্রয়োজনের তিন-চার গুণ বিল করে টাকা আত্মসাৎ করা হতো।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

রোমানা শারমিন ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ‘সংকল্প’ শীর্ষক ১৩ পর্বের একটি ধারাবাহিক নাটককের জন্য ৯ লাখ টাকা বাজেট দেখিয়েছেন। ওই নাটক নির্মাণই করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে প্রযোজক কন্ট্রোলার বা প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমিনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। দ্বীপ দর্পণ’ অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে অতিথি প্রযোজক সাখাওয়াত হোসেন মিঠু বলেন, ‘অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি কমবেশি হতে পারে। কিন্তু সময় কমলেও কোয়ালিটি নিয়ে আপস করিনি। অনুষ্ঠানে বিলের বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে সাবেক জিএম নুর আনোয়ার হোসেন রঞ্জু বলেন, আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। তারপরও চট্টগ্রাম কেন্দ্রের উন্নয়নে আমি অনেক কিছু করেছি। অনুষ্ঠান তৈরিতে আমি অর্থ অপচয় করিনি। কোন লুটপাট হয়নি। আমার সময়ে টেলিভিশনে কোনো সিন্ডিকেট ছিল না, এগুলো সব অপপ্রচার।’

সদ্য যোগদানকারী জিএম ইমাম হোসাইন বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বপ্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়া। বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে সেটা আমি নিশ্চিত করব।’

প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। গত ৩০ বছরে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক জিএম নিতাই কুমার ভট্টাচার্য ও মাহফুজা আক্তার, মনোজ সেন গুপ্ত, জাঁ নেসার ওসমানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। মাহফুজার বিরুদ্ধে ২১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

( বি; দ্র: প্রিয় পাঠক বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) নুর আনোয়ার হোসেন রঞ্জু ও প্রযোজক কন্ট্রোলার বা প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমিনের সম্পদের পাহাড় শিরোনামে আসছে পরবর্তি প্রতিবেদন। চোখ রাখুন আপনাদের প্রিয় দৈনিক ঈশানের প্রিন্ট ও অনলাইন ভার্সনে) 

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show